রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯:০২

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পিতৃ তর্পণ

বিমল চৌধুরী।।

পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহালয়ার প্রথম প্রহরে চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে পিতৃ তর্পণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোববার (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সকালে চাঁদপুর ইসকন মন্দিরের আয়োজনে শহরের ৫নং ঘাটে, কালীবাড়ি মন্দির কমিটির আয়োজনে নতুনবাজার মুখার্জি ঘাটে, পুরাণবাজার শ্রী শ্রী চন্দ্রেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরের আয়োজনে হরিসভা সংলগ্ন মেঘনা নদীর ঘাটে, পুরাণবাজার রামঠাকুর দোল মন্দিরের আয়োজনে দোল মন্দির ঘাটে, পুরাণবাজার দাসপাড়া সার্বজনীন শিব মন্দির কমিটির আয়োজনে পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজ ঘাটে এবং হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, হাইমচর, ফরিদগঞ্জ, কচুয়া মতলবসহ জেলার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ভক্তবৃন্দের আয়োজনে জেলায় প্রবাহিত মেঘনা, ডাকাতিয়া নদী ও বড় জলাশয়ে এই পিতৃ তর্পণ অনুষ্ঠিত হয়।

এদিন ভোরের আলোতে সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে তাদের পিতৃ পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনায় পবিত্র গঙ্গা জলে পুতপবিত্র হয়ে মন্ত্র পাঠের মধ্য দিয়ে তাদের প্রয়াত পিতৃ পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনায় জল বা পিণ্ড দান করেন।

প্রতি বছরই পিতৃপক্ষের বিদায় ও মাতৃ পক্ষের সূচনালগ্নে মহালয়ার প্রথম প্রহরে এই পিতৃ তর্পণ ক্রিয়াদি সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে পালন করে আসছেন। মহালয়ার প্রথম প্রহরে পিতৃ তর্পণ ক্রিয়াদি পূর্বে তেমনভাবে দেখা না গেলেও এখন প্রতিবছরই এর আয়োজন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত কয়েক বছর আগে চাঁদপুর কালীবাড়ি মন্দির কমিটির সাবেক সদস্য গোবিন্দ সাহার নেতৃত্বে কমিটির অন্য সদস্যরা সর্বপ্রথম চাঁদপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাপক আয়োজনে পিতৃ তর্পণ কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তী সময় তার ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়ে নতুন বাজার, পুরাণবাজারসহ জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে। এ বছর গোবিন্দ সাহার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন), চাঁদপুর ৫নং গুদারা ঘাট সংলগ্ন ডাকাতিয়া নদীতে নতুন করে প্রথমবারের মতো পিতৃ তর্পণ কার্যক্রম শুরু করে। একইভাবে মহালয়ার সকালে পুরাণবাজার শ্রী শ্রী চন্দ্রেশ্বরী কালীমাতা মন্দির কমিটি হরিসভা মন্দির কমপ্লেক্সে মহালয়ার গীতি নাট্যের আয়োজন করে। আয়োজনে ব্যাপক ভক্ত সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়েছে বলে জানা যায়।

পিতৃ তর্পণ শেষে আয়োজকদের ব্যবস্থাপনায় তর্পণকারীদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।

পিতৃ তর্পণ ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্নে আয়োজিত স্থানে নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশ সদস্যদের কার্যক্রম ছিলো প্রশংসনীয়। তারা শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করেন।

এদিন ভোরে অনুষ্ঠিত হয় মহালয়া। মহালয়াকে কেন্দ্র করে রেডিও টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে প্রকাশিত হয় দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের কাহিনী। শারদের ভোরের আকাশে চণ্ডিপাঠের মধ্য দিয়ে জানান দেয় শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা। দিন গণনায় এদিন থেকেই শুরু হয় দেবী পক্ষ। এদিন থেকেই দুর্গা পূজার ক্ষণ গণনা করা হলেও মহালয়ার সাথে দুর্গা পূজার কোনো সম্পর্ক নেই।

মহালয়া কথাটি এসেছে 'মহত্‍ আলয়' থেকে। হিন্দু ধর্মে মনে করা হয়, পিতৃ পুরুষের আত্মা এই সময়ে পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন জল ও পিণ্ড পাওয়ার আশায়। তাই এদিন সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষজন প্রয়াত পিতৃ পুরুষদের উদ্দেশ্যে জল ও পিণ্ড প্রদান করে তাঁদেরকে তৃপ্ত করেন।

প্রয়াত পিতৃ পুরুষগণ কেনো এই দিনেই মর্ত্যালোকে আসেন এবং জল পিণ্ড গ্রহণ করেন তারও ধর্মীয় ব্যাখ্যা রয়েছে বলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন। তারা মনে করেন, এর সঙ্গে মহাভারতের যোগ আছে। মহাভারতে বলা হয়েছে যে, মহাবীর কর্ণের আত্মা স্বর্গে গেলে সেখানে তাঁকে খেতে দেয়া হয় শুধুই সোনা আর ধনরত্ন। বিষয়টি কর্ণের কাছে কৌতূহল মনে হলে তিনি তা জানার উদ্দেশ্যে ইন্দ্রদেবকে জিজ্ঞাসা করেন। তখন ইন্দ্রদেব বললেন, তুমি সারাজীবন সোনাদানাই দান করেছো, কিন্তু পিতৃ পুরুষদেরকে কখনো কোনো জল দান করোনি। তাই তোমাকে মণি, মুক্তাখচিত ধনরত্নই খাবার হিসেবে দেয়া হচ্ছে। ইন্দ্রদেবের মুখে এ কথা শুনে কর্ণ বললেন, এতে আমার কী দোষ অছে বলুন? আমার পিতৃপুরুষের কথা তো আমি জানতে পারলাম কেবলমাত্র কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে। মা কুন্তী আমাকে এসে বললেন, আমি নাকি তাঁর ছেলে। তারপর যুদ্ধে ভাইয়ের হাতেই আমার মৃত্যু হলো। পিতৃ তর্পণ করার সময়ই তো পেলাম না। ইন্দ্র বুঝলেন, কর্ণের সত‍্যিই কোনো দোষ নেই। তাই তিনি কর্ণকে পনরো দিনের জন্যে মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিতে অনুমতি দিলেন। ইন্দ্রের কথা মতো এক পক্ষকাল ধরে কর্ণ মর্ত্যে অবস্থান করে পিতৃপুরুষকে অন্ন, জল দিলেন। তাঁর পাপ বিমুক্ত হলো। যে পক্ষকাল সময় কর্ণ মর্ত্যে এসে পিতৃপুরুষকে জল দিলেন, সেই পক্ষটি পরিচিত হলো পিতৃপক্ষ নামে। সে থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এই তর্পণের প্রথা চালু হয়। এই মহালয়া অমাবস্যা তিথিটি কেবল পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের তিথি হিসেবে নির্দিষ্ট হওয়ায় এদিন প্রাতে অনেকেই ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে শ্রদ্ধার সাথে তাদের প্রয়াত পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনায় তর্পণ করে থাকেন। আর পিতৃ পুরুষগণ তাদের সন্তানদের কাছ থেকে জল পেয়ে তাদেরকে আশীর্বাদ করে থাকেন বলে সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ বিশ্বাস করেন। তাদের সেই বিশ্বাস থেকেই তারা প্রতিবছরই দুর্গা পূজার আগে অর্থাৎ মহালয়ার দিন ভোরে পিতৃপুরুষের আত্মার সদগতি কামনায় পিতৃ তর্পণ করে থাকেন।

আর মহালয়া হলো দেবী পক্ষের সূচনা দিবস। এদিন মা দুর্গাকে মর্ত্যে আগমনের আহ্বান জানানো হয়। বিশ্বাস করা হয়, এদিনই দেবী কৈলাশ থেকে পৃথিবীর পথে রওনা দেন অসুর বধ ও ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য। মহালয়া শুভ শক্তির জাগরণ ও অশুভ শক্তি বিনাশের বার্তা বহন করে। এদিন থেকেই দুর্গা পূজার আমেজ শুরু হয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়