বুধবার, ০১ অক্টোবর, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৭

যে হারে হারের চেয়ে উপহাস অধিক

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
যে হারে হারের চেয়ে উপহাস অধিক

রাজার খেলা ক্রিকেট। কথাটা এমনি এমনি আসেনি। রাজা বলতে ক্ষমতায় নয় কিংবা ধনে-মানেও নয়। রাজার খেলা বলতে এখানে উচ্চমার্গের খেলা বোঝানো হয়েছে। এ খেলায় যতোটা না শারীরিক সক্ষমতা দরকার, তার চেয়ে বেশি দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা। এটা মুষ্টিযুদ্ধ নয় যে শক্তি প্রয়োগে কাজ হবে। এটি দৌড়ের বিষয় নয় যে ক্ষিপ্রতায় বিজয়ী হওয়া যাবে। এটি রাজার খেলা, কারণ প্রতিটি পর্যায়ে খেলাটি তার রূপ বদলাতে থাকে। বুুদ্ধির ধারে, প্রজ্ঞার ভারে এবং মেধার দ্যুতি দিয়ে খেলাটির অবস্থা পর্যালোচনা করতে হয়। এটি কোনো বলী খেলা নয় যে, দেহবলে কুপোকাত করা যায়। এটা একটা উচ্চ মেধার সমর। প্রতিটা মুহূর্তে মাঠ ও মাঠের বাইরে সমরের কথা চিন্তা করতে হয়। খেলার শুরুতে যে অবস্থা থাকে খেলার মাঝখানে সে অবস্থা থাকে না। আবার খেলার শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, সূচনার আভাসের সাথে পরিণামের বাস্তবতার কোনো মিল নেই। রাজা যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনায় পারিষদ নিয়ে বসতে হয়, তেমনি ক্রিকেটেও সময়ে সময়ে সে রকম আবশ্যকতা দেখা দেয়। খেলার মেজাজ ও গতি-প্রকৃতি যে ভালো বুঝতে পারে, ক্রিকেটে বিজয় তার করায়ত্ত হয়। এখানে ফর্ম যেমন দরকার, তেমনি প্রত্যুৎপন্নমতিত্বও দরকার। দরকার অভিজ্ঞানের সমন্বয়। এ খেলার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, খেলাটি কেবল ইংল্যান্ডের রাজন্যবর্গ খেলেছেন তা নয়, ভারতের নবাব পতৌদি খেলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার ডন ব্র্যাডম্যান খেলেছেন। পাকিস্তানের ওয়াসিম রাজা যেমন খেলেছেন, তেমনি কলকাতার মহারাজাও খেলেছেন। নামগুলো খেলোয়াড়ের হলেও তাদের বুদ্ধির বনেদীয়ানার কথাটাও মুখ্য। রাস্তাঘাট থেকে যাকে তাকে ধরে এনে মাঠে নামিয়ে দিলেই হবে না, তার মেধা থাকা চাই, তার বুদ্ধি থাকা চাই, থাকা চাই প্রজ্ঞা। কিন্তু গত ছাব্বিশ তারিখে এশিয়া কাপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে পাকিস্তানকে বাগে পেয়েও হারাতে না পারার কারণ খ্ুঁজতে গেলে যেটা বেরিয়ে আসে তাতে বুঝা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান ক্রিকেট দলটি আদৌ ক্রিকেটীয় মেজাজ ও দর্শনের সঙ্গেই যায় না। এরা আদতে হলো পাড়ার ফুটবল মাঠ বা ডাংগুলি খেলার গলি মাতানোর কুশীলব। এদের আচার-আচরণ, চলন-বাচনে ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের কোনো সূত্রই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কুড়ি ওভারের খেলায় পাকিস্তানের মতো একটা ক্রিকেটীয় বনেদী দলকে মাত্র একশো পঁয়ত্রিশ রানের খোলসে আটকানো গেলো, এটা মোটেই সহজ একটা কাজ নয়। যদিও প্রথম বারো ওভারে পঞ্চান্ন রান এবং পরের আট ওভারে আশি রানের ফারাকটা একটু বেশি হয়ে গেছে বলে মনে হয়। চাইলে হয়তো বা এ রান একশো পঁচিশেই আটকানো যেতো। কিন্তু ক্যাচ লোফার ব্যর্থতা দলকে ভোগান্তিতেই ফেলেছে শেষমেষ। কিন্তু খেলাটাকে একেবারেই লেজেগোবরে করা হয়েছে কুড়ি ওভারের ব্যাটিংয়ে। আগে থেকে নির্ধারিত হয়ে যাওয়া টার্গেটকে কীভাবে অতিক্রম করতে হয় তা যদি কোনো দল ছকমতো করতে না পারে তবে তাদের ক্রিকেট না খেলাই ভালো। কুড়ি ওভারের একশো কুড়ি বলে একশো ছত্রিশ রান করার লক্ষ্য যে দল অতিক্রম করার যুদ্ধবিদ্যা জানে না, তারা রাজার এ খেলাকে বিদায় জানানোই উচিত। ওভার প্রতি মাত্র ছয় দশমিক আট রান নিতে দরকার ছিলো বলে বলে রান নেওয়া, কোনো চার-ছক্কার বন্যা বইয়ে দেওয়া নয়। কিন্তু দেখা গেলো, আমাদের ব্যাটাররা একশো কুড়ি বলের মধ্যে ষাট বল রানশূন্য থেকেছে। অর্থাৎ তারা এই ষাট বলের প্রতিটিতেই চার-ছক্কা মারার প্রবণতা দেখিয়েছে। এর মধ্যে নয় বলে নয় উইকেট পতন হলেও বাজি একান্ন বল নষ্ট করেছে। অথচ দল হেরেছে মাত্র এগার রানে। একশো পঁয়ত্রিশ রান তাড়া করতে গিয়ে সাতটা ছয় এবং ছয়টা চারের চেয়েও দরকার ছিলো বলে বলে রান নেওয়া। কারণ বড়ো হিট করতে গেলেই উইকেট হারানোর ঝুঁকি বেশি। ঊনচল্লিশটি সিঙ্গেলস আর আটটি ডাবলস নিয়ে বাংলাদেশ দৌড়ে রান করেছে মাত্র পঞ্চান্নটি। অর্থাৎ যেখানে জেতার জন্যে ঝুঁকির চেয়ে ধৈর্য বেশি দরকার ছিলো, সেখানে সবাই বেধড়ক পিটিয়ে হিরো হওয়ার চেষ্টায় নিজের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসেছে। আত্মাহুতির এই ব্যবচ্ছেদ থেকে এটাই বোঝা গেলো, বাংলাদেশ দল ক্রিকেটীয় গণিতে দুর্বল এবং ক্রীড়া সমর-কৌশলে কাঁচা। তাই এদের খেলার মাঠজয়ে পাঠানোর আগে বুদ্ধি ও ক্রিকেটীয় বিদ্যায় পাকাতে হবে। শুধু শক্তির মহড়া দিয়ে ক্রিকেট জেতা যায় না। শামীম হোসেন পাটোয়ারীর পঁচিশ বলে তিরিশ রানকেও বড়ো করে দেখার সুযোগ নেই। কেননা, এর চেয়ে বরং ভালো হতো যদি ষাট বলে পঞ্চাশ রান করে দল জেতাতে পারতো। ক্রিকেটে ক্ষেত্রবিশেষে মেরে খেলার গুরুত্ব যেমন আছে তেমনি সময়মতো ধরে খেলারও গুরুত্ব অধিক।

পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি আসলে ধরে খেলার ম্যাচ ছিলো। একশো কুড়ি বলে একশো ছত্রিশ রান মানে শশকের চেয়ে শামুকের দরকার ছিলো সেদিন অধিক। উইকেট বাঁচাতে পারলে শেষ পাঁচ ওভারে চল্লিশ-পঞ্চাশ রান আদায় করা টি-টোয়েন্টিতে কোনো ব্যাপারই নয়।

এই ম্যাচে হার খেলোয়াড়ি দক্ষতার হার নয়। এই ম্যাচে হার মূলত ক্রিকেটীয় আনাড়িপনার স্বাক্ষর। তাই এ ম্যাচ নিয়ে ক্ষোভ যতো বেশি তার চেয়ে উপহাসের জোয়ার অধিক। কেউ কেউ ম্যাচে টাকাকড়ি লেনদেনের ঘ্রাণ পাওয়াটা তাই কপোল কল্পিত নয় মোটেই।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়