শুক্রবার, ১৩ জুন, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৫, ০২:৫৭

ঘেউ ঘেউ করার জন্য ইউরোপ টোকাইয়া ২০টা লোক’

— ইউনূস সফর ঘিরে শফিকুল আলমের স্ট্যাটাসে তোলপাড়

বিশেষ প্রতিনিধি :মো.জাকির হোসেন
ঘেউ ঘেউ করার জন্য ইউরোপ টোকাইয়া ২০টা লোক’
ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাজ্যে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাষ্ট্রীয় সফরের সময় প্রবাসী বিক্ষোভ ও তা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের সামাজিক মাধ্যমে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য ঘিরে দেশ-বিদেশে সৃষ্টি হয়েছে নানা আলোচনা, বিতর্ক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া।

চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস লন্ডনে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক, সেমিনার ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময়ে অংশ নেন। সফর চলাকালীন একটি ক্ষুদ্র আকারের বিক্ষোভ আয়োজন করে কিছু সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি, যারা তার বিরুদ্ধে “গোপন রাজনৈতিক চক্রান্ত”, “বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়ন” ও “বিচারাধীন মামলার” অভিযোগ তুলেন।

তবে এই বিক্ষোভ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় চলে আসে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস। তিনি লিখেছেন:

“ঘেউ ঘেউ করার জন্য পুরা ইউরোপ টোকাইয়া মাত্র ২০টা লোক পাইলো!”

এই মন্তব্য মুহূর্তেই ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। মন্তব্য ঘরে ছড়িয়ে পড়ে ব্যঙ্গ, রসিকতা, সমর্থন এবং প্রতিবাদ।

ভাইরাল প্রতিক্রিয়া: হাস্যরস বনাম সমালোচনা

স্ট্যাটাসটি ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে একাংশ সমর্থন করেছে শফিকুলের রসবোধকে, অন্যদিকে অনেকে এর ভাষার ধরন ও উপমার কঠোর সমালোচনা করেছেন।

আমিনুল ইসলাম লিখেছেন, “আল্লাহ্‌রে আল্লাহ্‌… আপনাদের জন্য মন খারাপ করে থাকতেও পারি না। এখন এর মাঝেও হাসছি! কী একটা অবস্থা!”

সাদিকুর রহমান খান লিখেছেন, “একবার নাস্তিক, আরেকবার টেরোরিস্ট—মানে গালি দিতে হবে কী, সেটাও জানে না টোকাইগুলা।”

মাবরুর রশিদ বান্না লেখেন, “আপনাদের BALদের এই হিউমারানি সেন্সকে অভিবাদন।”

তবে ভিন্ন মত দিয়ে আবু সাইদ আহমেদ মন্তব্য করেন:

“ইউরোপে স্বাধীন দেশের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। ২০ জন যদি আসে, তাহলে প্রায় প্রতি আড়াইটা দেশের একজন। একে কি আপনি কম বলবেন?”

বিক্ষোভের পরিসর: সংখ্যার লড়াই

বিক্ষোভ আয়োজকরা দাবি করেন, সেখানে ৫০ জনের বেশি প্রবাসী অংশ নেন। তবে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ও ঘটনাস্থলের ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রকৃতপক্ষে ১৮ থেকে ২০ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।

তারা “ইউনূসের বিচার দাবি” লেখা ব্যানার প্রদর্শন করেন, এবং “তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে বিদেশি চক্রান্ত” বন্ধের আহ্বান জানান।

প্রেস সচিবের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া

শফিকুল আলম সরাসরি কোনো সংবাদমাধ্যমে তার স্ট্যাটাস বিষয়ে মন্তব্য না করলেও ঘনিষ্ঠ সূত্রমতে, “উপহাস নয়, এটি ছিলো অপপ্রচারের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতীকী প্রতিবাদ”।

এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, “প্রতিনিয়ত অপপ্রচারের মধ্যে থাকা একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছ থেকে এমন রসবোধের বহিঃপ্রকাশ অস্বাভাবিক নয়। তবে ভাষার ব্যাখ্যা বিচারে মতপার্থক্য থাকতেই পারে।”

বিশ্লেষকদের মন্তব্য: রসিকতা নাকি দায়িত্বহীনতা?

একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “একটি রাষ্ট্রীয় সফর ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছ থেকে এমন মন্তব্য অনেকেই অপ্রত্যাশিত ভাবতে পারেন। কারণ, এটি শুধু সামাজিক রসিকতা নয়, সরকারের ভাবমূর্তি বহন করে।”

ড. ইউনূসের সফর: অর্জন বনাম বিতর্ক

সফরে ড. ইউনূস ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডসে বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি “নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার” মডেল তুলে ধরেন এবং ‘ডিজিটাল স্বচ্ছতা ও অর্থনৈতিক মানবতা’ বিষয়ে আলোচনা করেন। পাশাপাশি হাউজ অব লর্ডস সদস্য কার্লাইল, মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

তবে এই অর্জনগুলো ঢাকা পড়ছে একটি ছোট বিক্ষোভ এবং ফেসবুক স্ট্যাটাসের আলোচনায়।

প্রবাসী বাংলা গণমাধ্যমগুলো বলছে, “সফরের গাম্ভীর্য খর্ব হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাষিক প্রতিক্রিয়ায়।”

বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বিএনপি এই ঘটনাকে “ক্ষমতার দম্ভ” ও “ভাষাগত অসৌজন্যতা” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

এক সিনিয়র নেতা বলেন, “রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের উচিত সবসময় সংযত থাকা। শালীনতা হারিয়ে গেলে জনগণের আস্থা দুর্বল হয়।”

অপরদিকে ক্ষমতাসীন ঘরানার এক সাবেক কূটনীতিক মন্তব্য করেন, “একটি ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যকে এত বড় করে দেখার প্রয়োজন নেই। বরং এটিকে একটি গণতান্ত্রিক ‘মতপ্রকাশ’ হিসেবে দেখতে হবে।”

শব্দের শক্তি এবং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি

অল্পকথায় একটি ফেসবুক

ড. ইউনূসের জনপ্রিয়তা, তার সম্ভাব্য রাজনৈতিক ভূমিকা, এবং সেই প্রেক্ষাপটে সরকারের প্রতিক্রিয়া—সবকিছুরই প্রতিফলন ঘটেছে “২০টা লোক”-কে ঘিরে একটি বাক্যে।

বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমেই সোশ্যাল মিডিয়া ও জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিগত বক্তব্যের প্রভাবের অধীন হয়ে পড়ছে—যেখানে একটি বাক্য হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক আলোচনার উপকরণ।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়