প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৫
ওজোনস্তর ধ্বংস হলে আমাদের কী আসে যায়, আসুন জেনে নেই

ওজোনস্তর আসলে কী এবং মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীবজগতের উপর ওজোনস্তর কীভাবে প্রভাব ফেলে তা জানা না থাকলে তার সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা নিষ্ফল। ওজোনস্তর হচ্ছে পৃথিবীর মানুষসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় নিয়োজিত এক অনন্য প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাবলয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০ থেকে ৫০ কিলোমিটার উপরে বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার নামে যে স্তর রয়েছে তার উপরিভাগে যে আবরণ রয়েছে তার নামই হলো ওজোনস্তর। এই স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি বা আলট্রা ভায়োলেট রম্মির (বিশেষত UV-B I UV-C) প্রায় ৯৯ শতাংশ শোষণ করে লয় এবং পৃথিবীর জীবজগতকে রক্ষা করে। এই স্তরে ওজোন গ্যাস তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় থাকে। ওজোন (O3) মূলত তিনটি অক্সিজেন পরমাণুর সংযোজনে গঠিত এক বিশেষ ধরনের গ্যাস– যেখানে অক্সিজেনের তিনটি পরমাণু থাকে। এটি খুবই সক্রিয় গ্যাস যা মানুষ বা যেকোনো জীবজগতের জন্য বিষাক্ত।
ওজোনস্তর পৃথিবীর জীবমণ্ডল ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করে এবং জীবজগতের প্রজনন ও বিবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। ওজোনস্তর ক্ষয় হলে কৃষিজাত ফসল উৎপাদন, জলজ প্রাণীর সমৃদ্ধি, ও বনজ সম্পদের ভারসাম্য নষ্ট হয়। মানব সৃষ্ট বিভিন্ন কারণসহ গ্রীন হাউজ গ্যাসের প্রভাবে দিন দিন ওজোন স্তর ক্ষয়ে তৈরি হচ্ছে ওজোন হোল বা গর্ত। ১৯৮০-এর দশকে অ্যান্টার্কটিকার উপর ‘ওজোন হোল’ বা ওজোন স্তরের ছিদ্র আবিষ্কৃত হয়, যা বৈশ্বিক উদ্বেগের জন্ম দেয়। পরিবেশ দূষণ, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপন, অজৈব যৌগের অতিব্যবহারের ফলে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে এই সুরক্ষাবলয় ধীরে ধীরে ধ্বংস হচ্ছে ও মানবজীবন, প্রাণিকুল, উদ্ভিদ এবং সামগ্রিক পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এটি বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম বড় কারণ। তাই ওজোনস্তর সংরক্ষণ আজ বৈশ্বিক পরিবেশ সংরক্ষণের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ওজোনস্তর ক্ষয় বা ধ্বংসের মূল কারণ হলো মানবসৃষ্ট রাসায়নিক দূষণ। বিশেষত শিল্প ও প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত কিছু রাসায়নিক গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে যায় যা সূর্যের আলোতে বিক্রিয়া করে ওজোন অণু ধ্বংস করে। ওজনস্তর ক্ষয়ের অন্যান্য কারণের মধ্যে ক্লোরোফ্লোরোকার্বন, হ্যালন, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড ও মিথাইল ক্লোরোফর্মের মতো রাসায়নিক পদার্থ উল্লেখযোগ্য। এগুলো রেফ্রিজারেন্টর, স্প্রে, এয়ার কন্ডিশনার ও প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহৃত যৌগগুলো বায়ুমণ্ডলে উঠে ক্লোরিন পরমাণু মুক্ত করে, যা ওজোন অণুর সাথে বিক্রিয়া করে একে ভেঙে ফেলে। এই যৌগগুলো বায়ুমণ্ডলে উঠে ক্লোরিন ও ব্রোমিন মুক্ত করে, যা ওজোন অণুর সাথে বিক্রিয়া করে ওজোন ধ্বংস করে দেয়। একটি ক্লোরিন অণু প্রায় এক লাখ ওজোন অণু ধ্বংস করতে পারে। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, দ্রাবক ও রাসায়নিক দ্রবণে ব্যবহৃত হ্যালন, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড ও মিথাইল ক্লোরোফর্ম ইত্যাদি যৌগগুলো ওজোন ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিমান ও রকেট থেকে উচ্চমাত্রায় নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং ক্লোরিন নির্গত হওয়ার কারণে ওজনস্তর ক্ষয় হয়। বন ধ্বংসের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব বাড়ে, যা জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটিয়ে ওজোনস্তরের স্থিতি নষ্ট করে। ওজোন স্তর সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর ১৬ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব ওজোন স্তর সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ওজোনস্তর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলে এই রশ্মির মাত্রা বেড়ে যায় ফলে মানুষের ত্বকের ক্যান্সার, চক্ষু রোগ হয় এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। WHO এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ওজোনস্তর ১০% ধ্বংশ হলে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৩০ লাখ ত্বক ক্যান্সারের রোগী দেখা দিতে পারে। সমুদ্রের পৃষ্ঠে বসবাসকারী ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন, ক্রিল ও অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রাণীর ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে সমুদ্রে খাদ্য শৃঙ্খল ব্যাহত হয়। এটি মৎস্য সম্পদ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরুপ। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে UV-B রশ্মির অতিরিক্ত প্রভাবে ফসলের ক্লোরোফিল উৎপাদন কমে যায়, যার ফলে ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। উদ্ভিদের পাতার রোগ বৃদ্ধি, ফসলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায় ফলে ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস পায় এবং কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ওজোনস্তর ক্ষয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হয়, যা বনাঞ্চল, বন্যপ্রাণী ও পরাগায়ন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং বিপন্ন প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় যার ফলে হিমবাহ গলে যায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং বন্যা ও খরার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এইভাবে ওজোনস্তর জীবজগতের প্রতিটি ধাপে অদৃশ্য রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
উন্নত দেশগুলোর শিল্পায়ন ও অতিবিলাসী জীবনযাপনের কারণে দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবী। তাই ওজোন স্তর সংরক্ষণে প্রত্যেক দেশের দায়িত্ব রয়েছে। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। পৃথিবীর প্রায় ৬০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে থাকে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ভারত, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য। এসব দেশকে ওজোন স্তর রক্ষায় কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা উচিত। ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যসমূহের ব্যবহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা ও এসব দ্রব্যের বিকল্প ব্যবহার নিশ্চিত ও সহজ করা এখন সময়ের দাবি।
উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের বাস্তুসংস্থান রক্ষায় ওজোন স্তরের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োগ কমিয়ে নবায়নযোগ্য সম্পদের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শক্তির উৎস খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে সূর্যশক্তি, বায়ুশক্তি ও পানিশক্তি ব্যবহারের উপর জোর দিতে হবে। পৃথিবীতে আজ সর্বত্রই বিলাসবহুল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে যা ওজোনস্তর ক্ষয়কে বাড়িয়ে দিচ্ছে। নানা কারণে দৃশ্যমান হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। দেখা দিচ্ছে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী রেখে যেতে হলে ওজোনস্তর রক্ষায় শিল্পোন্নত দেশসমূহের পাশাপাশি সকল দেশকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ব্যাপারে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে ওজোনস্তর রক্ষায় ও সামগ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ওজোনস্তর ধ্বংসকারী দ্রব্যের ব্যবহার কমাতে মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করি।
ওজনস্তর সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে যেমন-
মন্ট্রিয়াল প্রটোকল (১৯৮৭ -এটি একটি ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক চুক্তি, যার মাধ্যমে CFCs, হ্যালন এবং অন্যান্য ওজোন ধ্বংসকারী পদার্থের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশ এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার (HFCs, CO₂ ও অ্যামোনিয়ার মতো প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে বিকল্প রেফ্রিজারেন্ট তৈরি করা হচ্ছে)। জনসচেতনতা বৃদ্ধি (স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলোর গণমাধ্যমে ওজোনস্তর রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বনায়ন ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাস (গাছপালা বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষার নিমিত্ত বন সংরক্ষণ ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা (ওজনস্তরের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ ও ক্ষয়প্রক্রিয়া রোধে উন্নত উপগ্রহ ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে)।
মানবসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ওজোনস্তর সংরক্ষণ অপরিহার্য, তাই বৈশ্বিক পর্যায়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। এর মধ্য দিয়েই আমরা পৃথিবীর সকল জীবের জন্য নিরাপদ ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
লেখক : পরিবেশ গবেষক ও সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম।



