বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৫৭

সিনেমায় আলঝাইমার্স

হাসান আলী
সিনেমায় আলঝাইমার্স

আলঝাইমার্স রোগ নিয়ে সারা পৃথিবীতে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা, হতাশা বিরাজমান। পৃথিবীর খ্যাতিম্যান ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। দিন দিন এই রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এই রোগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে বিভিন্ন দেশে সিনেমা তৈরি হয়েছে। নিচে পাঠকদের বিবেচনার জন্যে দশটি সিনেমার সংক্ষিপ্ত কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে--

১.The Father (2020)

কাহিনি : অ্যান্থনি নামের এক বৃদ্ধ ধীরে ধীরে আলঝাইমার্সের গভীরে তলিয়ে যান। দর্শক তার চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখতে শুরু করে—মানুষের মুখ বদলে যায়, স্মৃতি ও বাস্তবতার সীমানা মিলিয়ে যায়। সিনেমাটি দর্শককে রোগীর মনের ভেতর আটকে ফেলতে সক্ষম হয়, যাতে বোঝা যায় আলঝাইমার্স শুধু স্মৃতি হারানো নয়—এটি পরিচয়ের বিলুপ্তি।

২. Away from Her (2006)

কাহিনি : ৪৪ বছর সংসার করার পর ফিওনা আলঝাইমার্সে আক্রান্ত হন এবং একটি কেয়ার সেন্টারে থাকতে শুরু করেন। সেখানে তিনি নিজস্ব স্মৃতিবিশ্বে হারিয়ে গিয়ে অন্য এক পুরুষকে চিনতে শুরু করেন। তার স্বামী গ্র্যান্ট ধীরে ধীরে উপলব্ধি করেন, ভালোবাসা মানে কখনও কখনও প্রিয় মানুষটার সুখের জন্যে নিজেকে অদৃশ্য করে দেওয়া। স্মৃতি হারানো এবং ভালোবাসার এক মর্মস্পর্শী কাহিনি।

৩. Iris (2001)

কাহিনি : বিখ্যাত লেখিকা আইরিস মারডক তাঁর যৌবনে ছিলেন অগ্নিময় বুদ্ধিমত্তার অধিকারী, স্বাধীনচেতা নারী। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আলঝাইমার্সে আক্রান্ত হয়ে তিনি ধীরে ধীরে ভাষা হারান, চিন্তার দুনিয়া সংকুচিত হয়ে আসে। পুরো গল্পটি ঢেউয়ের মতো—একদিকে তার তারুণ্যের দীপ্তি, অন্যদিকে প্রবীণ বয়সে স্মৃতিভ্রমের অসহায়তা। তার স্বামী জন বেইলির নিঃস্বার্থ সেবাভাব এই ছবিকে গভীর মানবিকতা দিয়েছে।

৪. Memories of Tomorrow (Ashita no Kioku, Japan, 2006)

কাহিনি : সফল ব্যবসায়ী মাসায়ুকি যখন জানতে পারেন তিনি প্রাথমিক ধাপের আলঝাইমার্সে আক্রান্ত, তখন তার সামনে দুটি পথ—হাল ছেড়ে দেওয়া অথবা স্মৃতি ধরে রাখার শেষ পর্যন্ত লড়াই। তার স্ত্রী দৃঢ়ভাবে পাশে দাঁড়ান। সিনেমাটি জাপানি সমাজে রোগী ও সেবকের সম্পর্ক এবং সম্মানজনক বার্ধক্যের সংকট নিয়ে এক বাস্তবচিত্র তুলে ধরে।

৫. A Separation (Jodaeiye Nader az Simin, Iran, 2011)

কাহিনি : ইরানি সমাজের বাস্তবতায় নির্মিত এই চলচ্চিত্রে নাদেরের বাবা আলঝাইমার্সে আক্রান্ত। নাদের চাকরি, স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ সংকট, কিশোরী মেয়ের দায়িত্ব — সবকিছুর মাঝে তার বাবার ভুলোমনা, প্রস্রাব ধরে না রাখতে পারা, বাস্তব ভুলে শিশুর মতো আচরণ—এই সব মিলিয়ে প্রবীণ সেবার এক গভীর সংকট উন্মোচিত হয়। আলঝাইমার্স এখানে শুধু ব্যক্তিগত রোগ নয়, বরং পারিবারিক এবং সামাজিক সংকটের প্রতীক।

৬. Amour (2012, France-Austria)

কাহিনি : বৃদ্ধ দম্পতি জর্জেস ও অ্যান। অ্যান স্ট্রোকের পর মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা দ্রুত হারাতে থাকেন। যদিও এটি সরাসরি আলঝাইমার্স নয়, তবু স্মৃতিভ্রম, ভাষা হারানো, নিজেকে চেনার ক্ষমতা লোপ পাওয়া—সব লক্ষণেই দেখা যায় ডিমেনশিয়ার গভীর ছায়া। স্বামীর নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা, অদৃশ্য এক ভালোবাসাময় মৃত্যু—এই চলচ্চিত্র বার্ধক্য ও স্মৃতিহীনতার এক নির্মম কবিতা।

৭. The Notebook (2004)

কাহিনি : একটি বৃদ্ধাশ্রমে বসে বৃদ্ধ নোয়া প্রতিদিন এক নারীর কাছে একটি প্রেমের গল্প পড়ে শোনান। দর্শক ধীরে ধীরে টের পায়, তিনি আসলে নিজের স্ত্রীকে তারই প্রেমকাহিনি শোনাচ্ছেন—কিন্তু আলঝাইমার্সে আক্রান্ত স্ত্রী তাকে চিনতে পারেন না। মাঝে মাঝে ঝলকের মতো স্মৃতি ফিরে আসে, আবার হারিয়ে যায়। স্মৃতি ও ভালোবাসার এই ওঠানামা চলচ্চিত্রটিকে আবেগের শীর্ষে পৌঁছে দেয়।

৮. Robot & Frank (2012)

কাহিনি : ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে নির্মিত একটি অনন্য চলচ্চিত্র। বৃদ্ধ ফ্র্যাংক ধীরে ধীরে স্মৃতি হারাতে থাকেন। তার সন্তানরা তার দেখাশোনার জন্যে একটি রোবোটিক কেয়ারগিভার দেয়। রোবটটি তার ভুলোমনাকে সামলে রাখে, জীবনকে নতুনভাবে গুছিয়ে দেয়। প্রযুক্তি যখন প্রবীণ মানসিক স্বাস্থ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করে, তখন কেয়ার, মানবিকতা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যায়।

৯. The Savages (2007)

কাহিনি : দুই ভাইবোন—জন এবং ওয়েন্ডি—হঠাৎ খবর পান, তাদের বাবা আলঝাইমার্সে আক্রান্ত হয়ে সবকিছু ভুলে যাচ্ছেন। তারা নিজেদের ব্যস্ত জীবন ছেড়ে বাবার সেবার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন। এই ছবিতে দেখানো হয়েছে, আলঝাইমার্স শুধুমাত্র রোগীর নয়, সন্তানের মানসিক চাপ, অপরাধবোধ ও পারিবারিক সম্পর্কের নতুন পরীক্ষার নাম।

১০. Remember (2015) — কানাডা/জার্মানি

প্রধান চরিত্র : Zev Guttman—এক প্রবীণ হলোকাস্ট বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি, যিনি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত।

কাহিনি : জেভ একটি বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আরেক প্রবীণ বন্ধু ম্যাক্স তাকে মনে করিয়ে দেন—তাদের একমাত্র কাজ এখন প্রতিশোধ নেওয়া। কারণ হলোকাস্টের সময় যারা তাদের পরিবার হত্যা করেছিলো, তাদের মধ্যে একজন এখনও বেঁচে আছে। আলঝাইমার্স থাকা সত্ত্বেও জেভ ট্রেন ধরে, হোটেলে থাকে, মিশন চালিয়ে যায়—প্রতিবারই তিনি একটি কাগজ থেকে নির্দেশ পড়ে পরবর্তী পদক্ষেপ মনে রাখেন, কারণ স্মৃতি স্থায়ী থাকে না।

পাল্টা ধাক্কা : গল্পের শেষে জানা যায়, আসলে জেভ নিজেই সেই নাৎসি হত্যাকারী ছিলেন—কিন্তু ডিমেনশিয়ার কারণে তিনি নিজের অতীত ভুলে গিয়েছিলেন।

মূল বক্তব্য : স্মৃতি হারানো কেবল অসহায়ত্ব নয়, সেটি কখনও কখনও অপরাধবোধেরও আশ্রয়স্থান।

হাসান আলী : প্রবীণ বিষয়ে দেশখ্যাত গবেষক, আলোচক, প্রবন্ধকার ও গ্রন্থ প্রণেতা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়