প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৫৪
ভৌগোলিকভাবে কুমিল্লার গুরুত্ব

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত কুমিল্লা (আনুষ্ঠানিকভাবে কুমিল্লার বানান এখন ‘ঈঁসরষষধ’) কেবল ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক কারণে নয়, বরং এর কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জনপদ। কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করা এই জেলাটি প্রাচীনকাল থেকেই সমতট বা ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হিসেবে পরিচিত। এর ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নদীমাতৃক পরিবেশ এবং দেশের প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান এটিকে জাতীয় ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে এক অনন্য মর্যাদা দিয়েছে। কুমিল্লাকে প্রায়শই ‘ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী প্রবেশদ্বার’ (গেটওয়ে) হিসেবে অভিহিত করা হয়, যা এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের প্রধান কারণ।
কৌশলগত অবস্থান : ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রানজিট পয়েন্ট
কুমিল্লার ভৌগোলিক গুরুত্বের প্রধান ভিত্তি হলো এর কৌশলগত অবস্থান। এটি রাজধানী ঢাকা এবং প্রধান বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত।
প্রধান মহাসড়ক ও রেলপথের কেন্দ্র : ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক (এন ওয়ান) কুমিল্লার ওপর দিয়ে অতিক্রম করেছে। এটি দেশের বাণিজ্যিক লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত। সড়কপথের এই কেন্দ্রীয় অবস্থান কুমিল্লাকে দেশের প্রধান দুটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করেছে। একইভাবে, দেশের প্রধান রেলপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেও কুমিল্লা কাজ করে। সড়ক ও রেল—উভয় পথেই মসৃণ যোগাযোগ থাকার কারণে এটি পণ্য পরিবহন, বাণিজ্য এবং যাত্রী চলাচলের জন্যে একটি অপরিহার্য ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ বা মধ্যবর্তী মিলনস্থল। এর ফলে কুমিল্লার স্থানীয় অর্থনীতি গতিশীল হয় এবং দেশের সামগ্রিক সাপ্লাই চেইন সচল থাকে।
বিভাগীয় কেন্দ্রবিন্দু : প্রস্তাবিত কুমিল্লা বিভাগ (বৃহত্তর কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে) গঠিত হলে কুমিল্লা জেলা ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করবে। এর পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলার জনগণের জন্যে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষামূলক সেবার কেন্দ্র হিসেবে কুমিল্লা সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। এই কেন্দ্রীয় অবস্থান আঞ্চলিক প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্যে অপরিহার্য।
সীমান্ত সংযোগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
কুমিল্লার গুরুত্ব কেবল দেশের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ নয়, এর আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংযোগ এটিকে আরও বেশি কৌশলগত করেছে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রবেশদ্বার : কুমিল্লার পূর্বে রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। কুমিল্লার সঙ্গে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সীমান্ত সংযোগ এবং বিবির বাজার স্থলবন্দর এই অঞ্চলের ভৌগোলিক গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়েছে। এই স্থলবন্দর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও যোগাযোগ স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেল। পণ্য আমদানি-রপ্তানি ছাড়াও, এটি দু দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিনিময়ের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এই আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংযোগের কারণে কুমিল্লা ‘ট্রান্স-বর্ডার ইকোনমি’ বা আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র হিসেবেও চিহ্নিত।
সামরিক গুরুত্ব (কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট) : কুমিল্লার সামরিক গুরুত্বও এর ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও এই ক্যান্টনমেন্ট ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি প্রধান ঘাঁটি ছিলো। কৌশলগত অবস্থানে থাকার কারণে এই সামরিক স্থাপনাটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি প্রমাণ করে যে, সামরিক পরিকল্পনাতেও কুমিল্লাকে একটি কৌশলগতভাবে সংবেদনশীল এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও সম্পদ
কুমিল্লার ভূ-প্রকৃতি এর কৃষি, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
লালমাই পাহাড় ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ : কুমিল্লা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত লালমাই পাহাড় এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এই পাহাড়গুলো মূলত প্রাচীন মায়োসীন যুগের শিলা দ্বারা গঠিত, যা প্লাবনভূমি থেকে একে আলাদা করেছে। লালমাই-ময়নামতি এলাকায় আবিষ্কৃত শালবন বিহার ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রমাণ করে যে, এই উঁচুভূমিটি প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র ছিলো। এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত এবং তা কুমিল্লাকে ঐতিহ্যের মানচিত্রে স্থান দিয়েছে।
নদী ও প্লাবনভূমি : উর্বর কৃষিভূমি : কুমিল্লা প্রধানত একটি সমতল জেলা, যার অধিকাংশ এলাকা মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের দ্বারা বাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত প্লাবনভূমি। এই সমভূমি অত্যন্ত উর্বর, যা ধান, পাট এবং বিভিন্ন শাক-সবজি চাষের জন্যে বিশেষভাবে উপযোগী। এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে গোমতী, ডাকাতিয়া এবং ছোট ফেনী নদীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদী। বিশেষ করে গোমতী নদীকে কুমিল্লার দুঃখ ও আনন্দ দুটোই বলা হয়। এর পানি কৃষিতে সহায়ক হলেও, বর্ষাকালে বন্যা সৃষ্টি করে। এই নদীমাতৃক ভূ-প্রকৃতি কুমিল্লাকে কৃষি অর্থনীতিতে শক্তিশালী করেছে এবং স্থানীয় জলবায়ুকে প্রভাবিত করেছে।
জলবায়ু ও কর্কটক্রান্তি রেখা : কুমিল্লা ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এর ওপর দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে, যা এ অঞ্চলের তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং শীতকাল অপেক্ষাকৃত শুষ্ক থাকে। এই জলবায়ু এখানকার কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্যে অনুকূল।
অর্থনৈতিক ও শিল্প গুরুত্ব
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কুমিল্লা অর্থনীতিতে একটি গতিশীল কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
শিল্প ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) : দেশের প্রধান দুটি অর্থনৈতিক করিডোরের মাঝে থাকার কারণে কুমিল্লা শিল্প বিকাশের জন্যে একটি আদর্শ স্থান। এখানে স্থাপিত হয়েছে কুমিল্লা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড)। এই ইপিজেড আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানিতে এবং স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড়ো ভূমিকা রাখছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, কাঁচামাল প্রাপ্তির সুবিধা এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী অবস্থান শিল্পপতিদের কুমিল্লায় বিনিয়োগে উৎসাহিত করে।
বাণিজ্য ও ঐতিহ্যবাহী পণ্য : কুমিল্লা প্রাচীনকাল থেকেই বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধ ছিলো। গোমতী নদীর মাধ্যমে নদীপথে একসময় বাণিজ্য চলতো। এর ভৌগোলিক খ্যাতি খাদি কাপড় এবং রসমলাইয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী পণ্যের মাধ্যমেও দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাণিজ্য, কুটির শিল্প এবং অভিবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর ভিত্তি করে কুমিল্লার অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী।
ভৌগোলিকভাবে কুমিল্লা জেলা বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা, আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংযোগ, উর্বর প্লাবনভূমি, লালমাই পাহাড়ের মতো স্বতন্ত্র ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং আধুনিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে কেন্দ্রীয় ভূমিকা—এই সব কিছুই কুমিল্লার গুরুত্বকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন এবং বৃহত্তর প্রশাসনিক সুবিধার জন্যে একটি স্বতন্ত্র কুমিল্লা বিভাগ গঠন তাই কেবল একটি যৌক্তিক দাবি নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক মানচিত্রকে আরও সুসংগঠিত করার একটি কৌশলগত প্রয়োজন।
লেখক পরিচিতি : প্রভাষক, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ, মেহের ডিগ্রি কলেজ, শাহরাস্তি, চাঁদপুর।