প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩৬
চাঁদপুর সরকারি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী থেকে প্রথম অধ্যক্ষ
মো. তোয়াহা মিয়া শিক্ষায় স্মরণীয় ও বরণীয় একজন

কিছু মানুষ তাঁদের কর্ম, সততা ও মানবিক গুণাবলির কারণে অনন্য হয়ে উঠেন। তাঁরা আলোকিত করেন সমাজকে, গড়ে তোলেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে আলোর পথ দেখানো এমন একজন মানুষ ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক এ ডব্লিউ এম তোয়াহা মিয়া, যিনি শুধু শিক্ষক নন, ছিলেন এক আলোকবর্তিকা। এমন একজন মানুষ ছিলেন চাঁদপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রয়াত অধ্যাপক ‘আবদুল ওয়াহাব মোহাম্মদ তোয়াহা মিয়া’, যিনি ‘এ ডব্লিউ এম তোয়াহা মিয়া’ নামে বহুল পরিচিত। নিজের খুব কাছের বন্ধুর নাম ছিলো ‘আবদুল ওয়াহাব’। দু বন্ধু ছিলেন হরিহর আত্মা। তাই ঠিক করলেন, দু বন্ধু নিজের নামের আগে অপর বন্ধুর নাম যোগ করবেন! যেই চিন্তা সেই কাজ। শুধু ‘মোহাম্মদ তোয়াহা মিয়া’ বন্ধুর নাম নিজের নামের আগে যুক্ত করে হয়ে গেলেন ‘আবদুল ওয়াহাব মোহাম্মদ তোয়াহা মিয়া’। পরে যে নাম পরিচিত হয়ে উঠলো ‘এ ডব্লিউ এম তোয়াহা মিয়া’ হিসেবে।
চাঁদপুর সরকারি কলেজ ও মো. তোয়াহা মিয়া
চাঁদপুর সরকারি কলেজের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৬ সালের ১ জুন। দীর্ঘ ৩৩ বছর ৯ মাস পর ১৯৮০ সালের ১ মার্চ এটি সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয়। ঠিক এর কিছুদিন পর, ১৯৮০ সালের ১১ ডিসেম্বর অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন এ ডব্লিউ এম তোয়াহা মিয়া। এর আগে তিনি কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা করতেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, চাঁদপুর সরকারি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে তিনিই প্রথম কলেজের অধ্যক্ষ হন। তিনি প্রায় আট বছর ধরে (১১ ডিসেম্বর ১৯৮০—২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯) দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি কলেজের একাডেমিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। সরকারি হওয়ার পর কলেজের দীর্ঘ সময়ের অধ্যক্ষ হিসেবে তাঁর অবদান আজও শিক্ষার্থীদের মাঝে আলোচিত।
১৯৮৮ সালে কলেজের ৪২ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রথম পুনর্মিলনী আয়োজনের ক্ষেত্রে তাঁর আন্তরিক ভূমিকা ছিলো। এর ধারাবাহিকতায় আজ কলেজে নিয়মিতভাবেই প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
মেধাবী ছাত্র থেকে প্রেরণাদায়ী শিক্ষক
মো. তোয়াহা মিয়া ছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী। ১৯৫০ সালে উচ্চমাধ্যমিকে তিনি মেধা তালিকায় ১৭তম স্থান অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ কলেজ, কুমিল্লা পলিটেকনিক কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং পরবর্তীতে চাঁদপুর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন।
তিনি কেবল শ্রেণীকক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের তিনি নিজের বাসায় রেখে পড়াশোনার সুযোগ দিতেন। অনেককে থাকার জায়গা, খাওয়ার ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক সহায়তাও করেছেন। তাঁরই অনেক শিক্ষার্থী আজও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন প্রিয় তোহা স্যারকে। তাঁর স্ত্রী জাহানারা বেগম ছিলেন তাঁর সহযাত্রী। স্বামীর শিক্ষা-আদর্শকে সমর্থন করতেন সবসময়। তাঁদের সন্তানরাও নিজেদের পেশায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছেন।
স্মরণে তোয়াহা মিয়া
১৯৯৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, চাঁদপুর সরকারি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী থেকে প্রথম অধ্যক্ষ হওয়া সত্ত্বেও কলেজে তাঁর নামে আজও কোনো স্থায়ী স্মৃতি নেই। অথচ জেলার অন্যতম বিদ্যাপীঠের ইতিহাসে তিনি ছিলেন প্রথম সারির অবদানকারী।
তবে তাঁকে একেবারেই ভুলে যাওয়া হয়নি। তাঁর জন্মস্থান ফরিদগঞ্জের ২নং বালিথুবা (পূর্ব) ইউনিয়নের সরখাল গ্রামে ১৯৯৪ সালে তাঁর নামে একটি সেতু নির্মিত হয়—‘এ ডব্লিউ মো. তোয়াহা মিয়া সেতু’। এছাড়া ২০০৫ সালে সরখাল ওলিভ তরুণ সংঘের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘এ ডব্লিউ মো. তোয়াহা মিয়া স্মৃতি পাঠাগার’। এই পাঠাগারের মাধ্যমে প্রতিবছর কিছু সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়।
প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি
মো. তোয়াহা মিয়ার অবদান শুধু চাঁদপুর সরকারি কলেজেই নয়, জেলার শিক্ষাক্ষেত্রের বিস্তৃত পরিসরেই ছড়িয়ে আছে। জেলার আরেক বিদ্যাপীঠ পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের প্রথম সুধী সমাবেশেও তাঁর সরব উপস্থিতি ছিলো।
তবুও আজ প্রশ্ন থেকে যায়—চাঁদপুর সরকারি কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানে কেনো নেই তাঁর কোনো স্থায়ী স্মৃতি? একটি ভবন, একটি মিলনায়তন বা অন্তত একটি কক্ষে তাঁর নাম সংরক্ষিত হতে পারতো। এতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারতো তোয়াহা মিয়ার কর্ম ও ত্যাগের কথা।
অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে এ বিষয়ে মত দিয়েছেন। এমনকি তাঁকে নিয়ে একটি বই প্রকাশেরও উদ্যোগ চলছে। তাতে স্যারের জীবনী, কর্ম, স্মৃতিচারণ ও আলোকচিত্র স্থান পাবে।
মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। এ ডব্লিউ এম তোয়াহা মিয়া আজ আর নেই, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, আদর্শ ও ভালোবাসা চিরকাল থেকে যাবে তাঁর শিক্ষার্থীদের মনে। আমাদের দায়িত্ব হবে সেই স্মৃতি ধরে রাখা এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়া।
চাঁদপুর সরকারি কলেজে তাঁর স্মৃতিরক্ষায় একটি বলিষ্ঠ উদ্যোগ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। এটি হবে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা, শিক্ষার প্রতি সম্মান এবং ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক; সাধারণ সম্পাদক, সরখাল ওলিভ তরুণ সংঘ, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।
ই-মেইল :[email protected]