সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩৪

বিভুদার সততার মূল্য ও সাংবাদিকতার কঠিন বাস্তবতা

অসীম বিকাশ বড়ুয়া
বিভুদার সততার মূল্য ও সাংবাদিকতার কঠিন বাস্তবতা

সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’ এবং সম্প্রতি তাঁর আকস্মিক মৃত্যু বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পেশার এক করুণ ও কঠিন বাস্তবতাকে উন্মোচন করেছে। তাঁর লেখাটি কেবল ব্যক্তিগত হতাশার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি একটি সমাজের প্রতিচ্ছবি, যেখানে সততা ও আদর্শের মূল্য প্রায় শূন্য। তাঁর জীবন ও মৃত্যু আমাদের মনে গভীর কিছু প্রশ্ন রেখে গেছে।

সততার মূল্য ও সাংবাদিকতার বাস্তবতা

বিভুরঞ্জন সরকার তাঁর জীবনের দীর্ঘ পাঁচ দশক সাংবাদিকতা করেছেন। তাঁর পেশাগত জীবনে তিনি সবসময় সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং কোনো ধরনের আপসের আশ্রয় নেননি। ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে তিনি শিখেছেন, সত্য প্রকাশ করতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়। তিনি অনেক সময় ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন, কিন্তু কোনোদিন সত্যকে আড়াল করেননি। তাঁর এই আদর্শিক অবস্থান তাঁকে ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকারে বাধ্য করেছে।

যেখানে অনেক সাংবাদিক রাজনৈতিক সুবিধা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, তিনি সে পথে হাঁটতে অস্বীকার করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার সনদ বা প্লট পাওয়ার জন্যে তিনি কখনো অন্যায্য পথ অবলম্বন করেননি। এমনকি শেখ হাসিনার সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন করেও যখন তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, তখন তাঁর সততা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাঁর এই ত্যাগ এবং সততা তাঁকে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করেছে।

আর্থিক সংকট ও পারিবারিক যন্ত্রণার এক নীরব দলিল বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’টি তাঁর আর্থিক দুর্দশার এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরে। দীর্ঘ পাঁচ দশকের কাজের পরেও তিনি সম্মানজনক বেতন পাননি। নিজের এবং ছেলের চিকিৎসার জন্যে তাঁকে নিয়মিত ধার-দেনা করতে হয়েছে। তাঁর মেধাবী মেয়ে রাজনৈতিক কোপানলে পড়ে চাকরি জীবনে পিছিয়ে পড়েছে এবং বুয়েট থেকে পাস করা ছেলেটিও চাকরি পাচ্ছে না। এই পারিবারিক যন্ত্রণা তাঁকে প্রতিনিয়ত হতাশার মধ্যে রেখেছে।

তিনি দেখিয়েছেন, সাংবাদিকতা পেশায় টিকে থাকতে গেলে অনেক সময় আপস করতে হয়। যারা স্বার্থের জন্যে সত্যকে আড়াল করেন, তারাই সমাজে বেশি সুবিধা পান। বিভুরঞ্জন সরকার নিজের পত্রিকার ভেতরের অনিয়ম এবং রাজনৈতিক চাপের কথাও বলেছেন, যা তাঁকে মানসিকভাবে আরও কোণঠাসা করে ফেলেছিলো।

একটি মর্মান্তিক পরিণতি : প্রশ্নবিদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র

বিভুরঞ্জন সরকারের আকস্মিক মৃত্যু এবং তাঁর লেখা ‘খোলা চিঠি’ অনেকের কাছে একটি ‘সুইসাইড নোট’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যদিও এটি হত্যা না আত্মহত্যা, তা এখনো স্পষ্ট নয়, তবে তার চিঠিটি ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি সামাজিক ও পেশাগত চাপ সইতে না পেরে এমন মর্মান্তিক পথ বেছে নিয়েছেন।

তাঁর মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে শোক ও হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, এই রাষ্ট্র এবং সমাজ পরোক্ষভাবে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। যখন তিনি বেঁচে ছিলেন, তখন তাঁর যন্ত্রণা বোঝার বা শোনার সময় কারও ছিলো না, কিন্তু মারা যাওয়ার পর সবাই তাঁর জন্যে শোক প্রকাশ করছে।

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু এবং তাঁর ‘খোলা চিঠি’ কেবল একজন ব্যক্তির ট্র্যাজেডি নয়, বরং এটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সমাজের একটি কঠিন বাস্তবতা। এটি দেখিয়ে দেয়, কীভাবে একজন সৎ ও আদর্শবান মানুষ দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে কাজ করেও আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন। তাঁর মৃত্যু গণমাধ্যমকর্মীদের জন্যে একটি বেদনাদায়ক সতর্কবাণী, যা আমাদের বিদ্যমান সমাজ ও ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট; দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী; ভাইস-চেয়ারম্যান (কোরিয়া বাংলা প্রেসক্লাব) Whatsapp: +8201083727906 [email protected]

স্বায়ী ঠিকানা : গ্রাম : আবদুল্লাপুর, ডাক : ফতেপুর ৪৩৪৫ উপজেলা : ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়