শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১০:৫৭

চাঁদপুর পৌরসভা পরিচালিত বিদ্যালয়গুলো নিয়ে বিভ্রান্তি দূর হওয়া প্রয়োজন

রওশন আরা বেগম
চাঁদপুর পৌরসভা পরিচালিত বিদ্যালয়গুলো নিয়ে বিভ্রান্তি দূর হওয়া প্রয়োজন

সম্প্রতি পীর মহসিন উদ্দিন পৌর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়সহ চাঁদপুর পৌরসভা কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়গুলো নিয়ে কিছু গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য উপস্থাপন করে বাজেট-উত্তর বক্তব্য ছাপা হয়েছে। যা আমার দৃষ্টিগোচর হলে বিদ্যালয়গুলোর সঠিক ইতিহাস ও যথাযথ তথ্য তুলে ধরা উচিত বলে মনে করি। ইতোমধ্যে আমি খুব অসুস্থ ছিলাম বিধায় উল্লেখিত সংবাদের প্রেক্ষিতে যথাযথ বিষয়টি তুলে ধরতে একটু দেরি হলো, তবুও লিখছি।

চাঁদপুর পৌরসভার অধীনে তিনটি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। পৌর শহীদ জাবেদ উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জাবেদের নাম অনুসারে। এটি প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষার কার্যক্রম ও ভালো ফলাফলের মাধ্যমে আশপাশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করতে থাকে। অতঃপর এলাকার লোকজনের সুপারিশে বিদ্যালয়টিকে পৌরসভার সেবা ও শিক্ষা খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

হাফেজ মাহমুদা পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরীর মরহুম পিতা ও মাতার নামে ১৯৮৪ সালে নামকরণ করা হয়। অতঃপর এ বিদ্যালয়টি কিছুসময় পর পৌরসভার সেবা ও শিক্ষা খাত হিসেবে চাঁদপুর পৌরসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উক্ত বিদ্যালয়টি ১৯৮৮ সালে একাডেমিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়।

তৃতীয়ত পীর মহসিন উদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান জনাব সামছুদ্দিন আহমেদের প্রচেষ্টায় পীর মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার নামে নামকরণ করা হয়। পীর দুদু মিয়া হাজী শরীযুতুল্লাহর বংশধর ছিলেন। পৌর চেয়ারম্যান সাহেব ছিলেন পীর মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার একজন ভক্ত অনুরাগী। সে সময় তালতলা, বাসস্ট্যান্ড, তরপুরচণ্ডী, বিষ্ণুদী এলাকা হতে বাবুরহাট পর্যন্ত আশপাশের প্রায় দুই কিলোমিটার এরিয়ার মধ্যে কোনো বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ছিলো না। এ কারণে ১৯৮৬ সালে প্রান্তিক নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের পরামর্শক্রমে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিদ্যালয়টি ১৯৯১ সালে একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়।

বিদ্যালয়গুলো পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে পৌরসভার সেবা ও শিক্ষাখাত হিসেবে শিক্ষার্থীদের স্বল্প বেতনে পরিচালিত হয়ে আসছে। ক্রমান্বয়ে বিদ্যালয়গুলোর ব্যয়ের খাত বাড়তে থাকে।

তৎসময়ে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করার জন্যে চিন্তা-ভাবনা করেন। কীভাবে বিদ্যালয়গুলোর ব্যয়ভার কমানো যায়। সেই সময়ে পৌর চেয়ারম্যান জনাব ইউসুফ গাজী সাহেব ২০০০ সালে বিদ্যালয়গুলোর জন্যে সরকারি এমপিও ভাতা আনার উদ্যোগ নেন। সে সময়ে পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মহিউদ্দিন সাহেব এ ব্যাপারে বেশ প্রচেষ্টা চালান এবং কিছু কাগজপত্র প্রস্তুত করেন। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর ২০০১ সালে পৌর চেয়ারম্যান হিসেবে জনাব শফিকুর রহমান ভূঁইয়া পৌরসভার দায়িত্ব নেওয়ার পর তার অধিক আন্তরিকতা ও তিনটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বেশ কিছু শিক্ষককে সরকারি এমপিওভুক্ত করেন। এতে পৌরসভার আর্থিক একটা বিরাট অংশ সাশ্রয় হয়। এর মধ্যে ৭০% শিক্ষক অবসর গ্রহণে, কিছু শিক্ষক মৃত্যুজনিত ও ব্যক্তিগত কারণে অন্যত্র চলে যায়।

এতে বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পায়। তখন শিক্ষক সংঙ্কটে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হতে থাকে। যেমন : ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়গুলোর ফলাফল বিপর্যয় হয়। এরপর উল্লেখিত সময়ের সাবেক পৌর মেয়র জনাব নাসির উদ্দিন আহমেদ বিদ্যালয়গুলোর ভালো ফলাফল করার জন্যে আরো কিছু বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি একজন পৌর শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে জনাব ওয়াহাব মাস্টার (প্রাক্তন এটিইও)কে অস্থায়ীভাবে সামান্য বেতনে নিয়োজিত করেন। মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয় পরিচালনার জন্যে শিক্ষক সেটআপে ১৬-১৭ জন শিক্ষক আবশ্যক। কিন্তু সেই সময়ে নিবন্ধনবিহীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না বিধায় তিনি সাময়িক ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া বন্ধ করে দেন। এতে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সঙ্কট আরো বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে পৌর হাফেজ মাহমুদা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ ৬ জন এবং পীর মহসিন উদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ মোট আটজন শিক্ষক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয় পরিচালনা করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়। তৎসময়ে পৌর শহীদ জাবেদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব ওমর ফারুক সাহেব শিক্ষা কর্মকর্তা জনাব ওয়াহাব মাস্টারের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে নিজ বিদ্যালয় ও হাফেজ মাহমুদা বিদ্যালয়সহ দুটি বিদ্যালয়ে অনেকটা শিক্ষক সঙ্কট হ্রাস করেন। এতে তার বিদ্যালয় ও হাফেজ মাহমুদা বিদ্যালয়ে শিক্ষক সঙ্কট কমে যায়। কিন্তু পীর মহসিন উদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক সঙ্কট বরাবরের মতো থেকে যায়। তারপরও আমার আন্তরিকতা ও অন্যান্য শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এবং ২/৩ জন প্রাক্তন ছাত্রীর মাধ্যমে বিদ্যালয়টিতে আশানুরূপ ফলাফল ধরে রাখি। তখন এ বিদ্যালয়ে পাসের হার ৬০% হতে ৭০%-এর উপরেও ধরে রাখা সম্ভব হয়। বিগত ৫/৬ বছর যাবৎ প্রায় ২/৩ জন করে শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ ধরে রাখতে সক্ষম হই এবং পৌরসভার শিক্ষার মান উন্নত রাখতে চেষ্টা করি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, চাঁদপুরে অনেক বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকেও পৌর উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর বোর্ডের ফলাফল ভালো ও সন্তোষজনক।

২০২০ সালে পৌর মেয়র জনাব জিল্লুর রহমান জুয়েল দায়িত্ব নেওয়ার পর পৌর শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন জনাব ওমর ফারুক, যিনি পৌর শহীদ জাবেদ উচ্চ বিদ্যালয়েরও প্রধান শিক্ষক। জনাব ওমর ফারুক পৌর শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর পৌর মেয়র জিল্লুর রহমানের সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেন। এ সুযোগে সাময়িক ভিত্তিতে অল্প সময়ের মধ্যে তার বিদ্যালয়ে আরো কিছু শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। এতে তার বিদ্যালয়ে মোটামুটি শিক্ষক সংকট দূর হয় এবং তিনি বিদ্যালয়টিকে কলেজে উন্নীত করেন। এ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি নিজে নিয়োজিত হন। ইতোমধ্যে তিনি সাময়িকভাবে শিক্ষক ও নিবন্ধনকৃত শিক্ষকদের চাকুরির স্থায়ীকরণের লক্ষ্যে হাফেজ মাহমুদা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঙ্কট পূরণ করেন। তিনি মেয়র সাহেবের ঘনিষ্ঠ লোক হওয়ায় তার পক্ষে সরকারি এমপিওভুক্ত করা খুব সহজ ব্যাপার ছিলো। কিন্তু পীর মহসিন উদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় অনেক অনুরোধের পর মাত্র শূন্য পদে একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং দুজন সহকারী শিক্ষকের এমপিওর ব্যবস্থা করেন। এতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইংরেজিসহ আরো ৬টি বিষয়ে বিদ্যালয়ে শূন্য পদ থেকেই যায়। সেই সময়ে আমি ছিলাম একজন হতভাগা বিরোধী দলের নেতার স্ত্রী। তাই আমি ও আমার প্রতিষ্ঠান অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয়েছি।

যাক এ নিয়ে আর নাই-বা কিছু বললাম। আমার এই লেখা কারোর প্রতি রাগ, ক্ষোভ কিংবা প্রতিবাদ হিসেবে নয়, শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষকদের সম্মানার্থে বিগত ও বর্তমান কমিটির সম্মানিত সদস্যদের অনুরোধে লেখা। প্রকাশিত গণমাধ্যম তথা পত্রিকায় বিদ্যালয়গুলোর যে বিরাট আর্থিক ব্যয় দেখানো হয়েছে, বর্তমানে উল্লেখিত ব্যয়ের অর্ধেকের চেয়ে অনেক কম ব্যয় হয় উল্লিখিত পৌর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা খাতে। কারণ পরবর্তীতে এমপিওভুক্ত নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ বেসরকারি নিয়মে সরকারি এমপিওভুক্ত টাকা এবং বিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে ১০% বেতন ভাতা গ্রহণ করেন। আমার কয়েকজন সাংবাদিক ভাইয়ের কাছে অনুরোধ, প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কিছু লিখতে হলে প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সাথে যোগাযোগ করে লিখলে তা সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্যভিত্তিক সংবাদ হিসেবে গৃহীত হবে। তবে আশার আলো যে, পৌর প্রশাসক জনাব মো. গোলাম জাকারিয়া মহোদয় (উপ-সচিব) পৌরসভার বিভিন্ন খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় কমিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পৌর আয় বৃদ্ধি করেন। তিনি পৌরসভার নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধিসহ শিক্ষা খাতে বিশেষভাবে নজর দিয়েছেন। এতে পৌর নাগরিকদের কাছে তিনি প্রশংসিত হচ্ছেন। ইনশাআল্লাহ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অচিরেই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করবে। পরিশেষে পীর মহসিন উদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সকল সমস্যা দূর করে যাতে ভবিষ্যতে পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত একটি আদর্শ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় এ আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

রওশন আরা বেগম : প্রধান শিক্ষিকা, পীর মহসিন উদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়