প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪১
বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন প্রয়োজন

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, যার অর্থনীতি কৃষি, পোশাকশিল্প, রেমিট্যান্স এবং সাম্প্রতিক সময়ে তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের যুগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) শুধু একটি খাত নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের সফল বাস্তবায়নের পর এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার পথে বাংলাদেশ। এই রূপান্তরকে বাস্তবায়ন করতে হলে তথ্য-প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, কারণ এটি কর্মসংস্থান, রপ্তানি আয়, দক্ষ মানবসম্পদ এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল করতে পারে।
|আরো খবর
তথ্য-প্রযুক্তি খাতের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে তথ্য-প্রযুক্তি খাতের বিকাশ গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য হলেও এখনও এটি জাতীয় অর্থনীতিতে মাত্র ১ শতাংশ অবদান রাখছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) অনুযায়ী, বর্তমানে আইসিটি খাতে কর্মসংস্থান রয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষের। এই সংখ্যা ১৮ কোটি জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য। তবে সম্ভাবনার দিক থেকে এটি একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র, যেখানে সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব।
সরকারের উদ্যোগ ও নীতিমালা
বাংলাদেশ সরকার তথ্য-প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ই-গভর্নেন্স, অনলাইন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ডিজিটাল পেমেন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং এবং তথ্যভিত্তিক সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে নাগরিক জীবন সহজতর হয়েছে। বর্তমানে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে সরকার তথ্য-প্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতি, স্টার্টআপ ফান্ড, হাইটেক পার্ক নির্মাণ এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। তবে এই উদ্যোগগুলোকে আরও কার্যকর করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, গবেষণা ও উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
অর্থনীতিতে তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাব
তথ্য-প্রযুক্তি খাত অর্থনীতিকে বহুমাত্রিকভাবে প্রভাবিত করে। প্রথমত, এটি রপ্তানি আয় বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সফটওয়্যার, আইটি সার্ভিস এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। দ্বিতীয়ত, এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, বিশেষ করে তরুণদের জন্যে। তৃতীয়ত, তথ্যপ্রযুক্তি খাত উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। কারণ ডিজিটাল অটোমেশন, ডেটা বিশ্লেষণ এবং ক্লাউড প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবসা ও শিল্প খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
চতুর্থত, এটি উদ্যোক্তা-সংস্কৃতি গড়ে তোলে, যেখানে স্টার্টআপ, ইনোভেশন এবং প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান অর্থনীতিকে গতিশীল করে।
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন
তথ্য-প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নের জন্যে প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ। বাংলাদেশে আইসিটি শিক্ষার প্রসার ঘটলেও এখনও কারিগরি দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেটা সায়েন্স, সাইবার সিকিউরিটি এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিষয়ে আরও গভীর পাঠদান প্রয়োজন। পাশাপাশি, টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, অনলাইন কোর্স এবং ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তরুণদের দক্ষ করে তুলতে হবে। সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে, যা কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়ক হবে।
উদ্ভাবন ও স্টার্টআপ সংস্কৃতি
তথ্য-প্রযুক্তি খাতের প্রাণ হচ্ছে উদ্ভাবন। বাংলাদেশে স্টার্টআপ সংস্কৃতি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। ফিনটেক, এডটেক, হেলথটেক, ই-কমার্স এবং এগ্রিটেক খাতে অনেকড তরুণ উদ্যোক্তা কাজ করছেন। তবে তাদের জন্যে প্রয়োজন বিনিয়োগ, মেন্টরশিপ এবং বাজারে প্রবেশের সুযোগ। সরকার যদি স্টার্টআপদের জন্যে কর অব্যাহতি, সহজ ঋণ এবং হাইটেক পার্কে জায়গা বরাদ্দ দেয়, তাহলে এই খাত আরও প্রসারিত হবে। উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিল্পখাতের সংযোগ বাড়াতে হবে।
রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
বাংলাদেশের রপ্তানি খাত দীর্ঘদিন ধরে পোশাক শিল্পনির্ভর। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাত একটি বিকল্প রপ্তানি খাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সফটওয়্যার, মোবাইল অ্যাপ, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং আইটি সার্ভিস রপ্তানি করছে। ফ্রিল্যান্সাররা Upwork, Fiverr, Freelancer.com-এর মতো প্ল্যাটফর্মে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। এই খাতকে আরও বিস্তৃত করতে হলে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ, সার্টিফিকেশন এবং ভাষাগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের আইটি ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন।
চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা
তথ্য-প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, যেমন উচ্চগতির ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং প্রযুক্তি সরঞ্জামের অভাব। দ্বিতীয়ত, দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি। তৃতীয়ত, নীতিগত জটিলতা ও আমলাতান্ত্রিক বাধা। চতুর্থত, সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্য সুরক্ষার অভাব। পঞ্চমত, নারীদের অংশগ্রহণ কম। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকার, বেসরকারি খাত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
নারীর অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তি
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ এখনও সীমিত। সামাজিক বাধা, নিরাপত্তা এবং প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক নারী এই খাতে প্রবেশ করতে পারেন না। তবে নারীদের অন্তর্ভুক্তি অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। নারী উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার এবং প্রযুক্তি পেশাজীবীদের জন্যে আলাদা প্রশিক্ষণ, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ‘She Power’ বা ‘Women in Tech’ উদ্যোগের মাধ্যমে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব।
সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্য সুরক্ষা
তথ্য-প্রযুক্তি খাতের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত তথ্য, আর্থিক লেনদেন এবং সরকারি ডেটা সুরক্ষায় শক্তিশালী সাইবার আইন, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং জনসচেতনতা প্রয়োজন। সরকারকে সাইবার সিকিউরিটি পলিসি, ডিজিটাল ফরেনসিক এবং তথ্য সুরক্ষা প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে। পাশাপাশি, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে সাইবার সচেতনতা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
ভবিষ্যৎ রূপরেখা
বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে তথ্য-প্রযুক্তি খাতকে একটি কৌশলগত স্তরে উন্নীত করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়, ৬০ লাখ কর্মসংস্থান এবং ১০ হাজার স্টার্টআপ গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এজন্যে প্রয়োজন :
– দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা ও রোডম্যাপ
– শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন
– অবকাঠামো ও কানেক্টিভিটি
– বিনিয়োগ ও স্টার্টআপ সহায়তা
– নারীর অন্তর্ভুক্তি
– সাইবার নিরাপত্তা
– আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং
তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যে একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। এটি শুধু কর্মসংস্থান বা রপ্তানি নয়, বরং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের পথ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের জন্যে তথ্য-প্রযুক্তি খাতকে তাই অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করা হয়।







