সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:০৩

কলেরার কথা

ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
কলেরার কথা

কলেরা কী

কলেরা একটি জলবাহিত, নিরাময়যোগ্য এবং পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণশীল রোগ যার জন্যে ভিব্রিও কলেরি নামে একটি জীবাণু বা ব্যাক্টেরিয়া দায়ী। আগে গ্রামের পর গ্রাম কলেরায় আক্রান্ত হয়ে উজাড় হয়ে গেছে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে। এই জীবাণু দেহে অনুপ্রবেশের পর চব্বিশ ঘণ্টা হতে পাঁচদিনের মধ্যে কার্যকারিতা শুরু করে।

কলেরার মিথ

কলেরাকে আগেকার দিনে গ্রাম বাংলায় বলা হতো ওলাওঠা। ওলা মানে নামা। অর্থাৎ মলত্যাগ। ওঠা মানে বমন বা বমি হওয়া। অর্থাৎ ওলাওঠা বা কলেরায় একই সাথে পাতলা পায়খানা যেমন হয় তেমনি বমিও হয়। এই রোগকে অন্যনামে বিসূচিকা রোগও বলা হয়। ওলাবিবি বা ওলাওঠা দেবির কথা জানা যায় ‘বিবির গান’ নামে লোককথায়। আগে বর্ষাকালে ওলাবিবির প্রাদুর্ভাব হতো। মূলত মানুষের অজ্ঞতাতেই এ রোগ ছড়ায় এবং মানুষ মারা যায়। আগে কোন বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি বিধায় মানুষ ওলাওঠার পূজা করতো কিংবা ওলাবিবির কাছে মানত করতো।

কলেরার জীবাণু ও সংক্রমণ

কলেরার জীবাণু বা ভিব্রিও কলেরি একটি কমা আকৃতির জীবাণু বা ব্যাক্টেরিয়া যা মানুষের পরিপাকতন্ত্রের ক্ষুদ্রান্ত্রে ঘাঁটি করে এবং ক্লোরাইড জাতীয় লবণ ও পানি শুষে বের করে দেয়। ফলে এতে পাতলা যে মল বের হয় তা চালধোয়া পানির মতো সাদা দেখায়।

বিজ্ঞানী রবার্ট কচ কলেরার জীবাণু আবিষ্কার করেন। বৃটিশ চিকিৎসক ও অবেদনবিদ ডা. জন স্নো প্রথম নিশ্চিত করেছিলেন, কলেরা ছড়ায় জীবাণু সংক্রমিত পানির মাধ্যমে। তাঁর অনুসন্ধানে উঠে আসে, জীবাণুযুক্ত পানি পানে কলেরা হয়। বাঙালি বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে কলেরা জীবাণুর এন্টারোটক্সিন এর সংক্রামণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ফলে কলেরার বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা সম্ভব হলো এবং বিপুল সংখ্যক মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হলো।

মূলত কলেরায় আক্রান্ত মানুষের মল হতে জীবাণু পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে। এই পানি পান করে সুস্থ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়। আবার তার মল হতে একই প্রক্রিয়ায় এই রোগ বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

কলেরার লক্ষণ

* চালধোয়া পানির মতো সাদা তরল মল। এতে মল কম জল বেশি থাকে।

* রোগী পেটে কামড় বা ব্যথা বোধ করে।

* পাতলা পায়খানার সাথে বমিও হয়।

* জীবাণুর কারণে সৃষ্ট এন্টারোটক্সিনের কারণে জ্বর হতে পারে।

* মলে তীব্র দুর্গন্ধ থাকে।

* আক্রান্ত রোগীর তীব্র পানিশূন্যতা দেখা দেয়।

* রোগীর পায়ের পেশিতে খিঁচুনী হয়।

* রোগী শকে চলে যায়, রক্তচাপ পাওয়া যায় না।

* রোগী এক পর্যায়ে মৃত্যুবরণ করে।

কলেরা রোগী সনাক্তকরণ

* সাধারণত কলেরার প্রাদুর্ভাব আছে এমন এলাকায় রোগীর লক্ষণ এবং মলের বর্ণ ও প্রকৃতি হতে কলেরা রোগী সনাক্ত করা যায়।

* যে সব এলাকায় কলেরার প্রাদুর্ভাব হয়নি সেসব এলাকায় কালচার পদ্ধতিতে জীবাণু সনাক্ত করা হয় এবং পিসিআর ও র‌্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে কলেরায় আক্রান্ত রোগী নিশ্চিত করা হয়।

কলেরার চিকিৎসা

* রোগীকে আলাদা করতে হবে

* রোগীর পানিশূন্যতা ও ইলেকট্রোলাইট ঘাটতি পূরণ করতে হবে। মুখে ওআরএস বা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট হতে স্যালাইন বানিয়ে খাওয়াতে হবে। অধিক পানিশূন্যতা হলে শিরাপথে কলেরা স্যালাইন দিতে হয়। একে রিহাইড্রেশন বা পুনরুদন বলে।

* আজকাল কলেরা রোগীকে একগ্রাম অ্যাজিথ্রোমাইসিন মুখে একক ডোজ হিসেবে খাওয়ানো হয়। এতে কলেরা জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়।

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই মাত্রা ওজন অনুপাতে ঠিক করে নিতে হয়।

* বাচ্চাদের রাইস স্যালাইন বানিয়ে খাওয়ালে উপকার তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়।

* মুখে জিঙ্ক ট্যাবলেট বা সিরাপ দিয়ে জিঙ্কের ঘাটতি পূরণ করতে হয়।

কলেরা বা ডায়রিয়ায় ওআরএস

ওআরএস বা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট ও সলিউশনকে বলা হয় বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে সেরা আবিষ্কার। এর আবিষ্কারে পশ্চিমবঙ্গের ডা. দিলীপ কুমার মহলানবিশ এবং কুমিল্লার ডা. রফিকুল ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু একে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি এনে দিতে অবদান রেখেছেন চট্টগ্রামের ডা. ধীমান বড়ুয়া। এই ওআরএস বা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্টের কারণে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।

কলেরা প্রতিরোধ

* কলেরা প্রতিরোধে বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকতে হবে

* শৌচাগার ব্যবহারের পরে, খাদ্য তৈরির আগে, খাবার খাওয়ার সময় সাবান বা হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে প্রবহমান পানিতে হাত ধুতে হবে

* পানি ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে পান করতে হবে

* খাবার ঢেকে রাখতে হবে

* বন্যায় বিশুদ্ধ পানি না পেলে পানি বিশোধনকারী ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে

* স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে জনগণকে শিক্ষা দিতে হবে

কলেরা ভ্যাক্সিন

আঠারশ চুরানব্বই সালের মার্চে রাশান প্রাণীবিজ্ঞানী ওয়ালডেমার মোরডেকাই হাফকিন প্যারিস এবং ভারতে গবেষণা চালিয়ে কলেরা রোগের প্রথম ভ্যাকসিন তৈরি করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে কলেরা ভ্যাক্সিন ব্যবহার করে কলেরার প্রাদুর্ভাব কমানোর রেডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। দুহাজার বাইশ-তেইশ সালে পঁয়ত্রিশ লাখ লোকের মধ্যে কলেরা ভ্যাক্সিন সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়