সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

বরেণ্য সাঁতারু অরুন নন্দী

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
বরেণ্য সাঁতারু অরুন নন্দী

বাংলাদেশের যে ক’জন বরেণ্য সাঁতারু নিজে যেমন আলো ছড়িয়েছেন, তেমনি আলোকিত করেছেন অনেক মানুষকে- অরুন নন্দী নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার লক্ষ্যে তিনি অবিরাম ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার কেটে বিশ্বরেকর্ড করেন। তাই তাঁকে স্বাধীনতার সাঁতারু বলা হয়।

অরুন নন্দীর জন্ম চাঁদপুরের বাগাদী গ্রামে। বাবা কুমুদ বন্ধু নন্দী, মা কিরণ বালা। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাগাদীতে বেড়ে ওঠা। এ গ্রামেই তিনি পেয়েছেন সাঁতারু হওয়ার প্রেরণা। নিজের গ্রাম সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘শৈশবের কত স্মৃতি যে জড়িয়ে আছে এ গ্রামটির সঙ্গে! আমার বুকে সাঁতারু হওয়ার স্বপ্নের বীজ বপন করে দেয় আমার প্রিয় এই গ্রামটি। এমন একটি গ্রামে জন্ম নেয়ায় এর কাছে আমার অশেষ ঋণ। আমি যেখানেই যাই, যত দূরে যাই না কেন, আমার অন্তরজুড়ে থাকে ছায়াঘেরা, পাখিডাকা অমলিন এই গ্রামখানি।’ অরুন নন্দীর শৈশবের নদী ডাকাতিয়া। তিনি পুকুর, খাল ও নদীতে সাঁতার কাটতেন। ক্রমেই সাঁতার হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

১৯৪৭ সালে নন্দী পরিবার বাগাদী ছেড়ে চাঁদপুর শহরের কদমতলায় চলে আসেন। পুরাণবাজার ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়। তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন মধুসূদন স্কুলে। পরবর্তী পাঠশালা ডিএন স্কুল। এরপর পড়াশোনা করেছেন চাঁদপুর সরকারি কলেজে। অরুন নন্দী শৈশব থেকে বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া শুরু করেন। ১৯৫০ সালে পুরাণবাজারে একজন ইংরেজ আয়োজিত সাঁতার প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম হয়ে স্বর্ণের মেডেল অর্জন করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৯ বছর! এ প্রাপ্তি সাঁতারে তাঁর উৎসাহ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তিনি পরবর্তীতে জেলার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং পুরস্কৃত হন। ১৯৫৬ সাল থেকে টানা তিনবার ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতারে জেলা চ্যাম্পিয়ন হন অরুন নন্দী। চাঁদপুর কলেজে পড়াকালে আন্তঃকলেজ সাঁতারে রানার্সআপ হন ১৯৫৯ সালে।

১৯৫৬ সালে অরুন নন্দী প্রথমবারের মত দূরপাল্লার সাঁতারে অংশ নেন। এতে তিনি দ্বিতীয় হন। ১৯৫৭ সালে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে দুই মাসের সাঁতার প্রশিক্ষণ তাঁকে আরো দক্ষ করে তোলে। অল্পবয়সেই সাঁতারু হিসেবে অরুন নন্দীর খ্যাতি চাঁদপুর ও আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত ১৯৫৯ সালে চাঁদপুরে ১৪ ঘণ্টার অবিরাম সাঁতারের পর সর্বমহলে তিনি প্রশংসিত ও আলোচিত হন। স্মৃতিকথায় অরুন নন্দী জানিয়েছেন, ‘চাঁদপুরের জোড়পুকুর পাড়ে ১৯৫৯ সালের ২২ আগস্ট সাঁতার আয়োজনের তারিখ নির্ধারিত হয়। এ সাঁতারকে কেন্দ্র করে আলোড়ন সৃষ্টি হয় চাঁদপুরে। আমার সাঁতার উপলক্ষে চাঁদপুরের সব স্কুল ও কলেজ ছুটি দেয়া হয়েছিল।’ অরুন নন্দীর সাঁতারের খবর ২৩ আগস্ট কুমিল্লার বিখ্যাত আমোদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাতে লেখা হয় : ‘স্থানীয় জোড়পুকুরে চাঁদপুরের বিখ্যাত সাঁতারু অরুন কুমার নন্দী অবিরাম ১৪ ঘণ্টা সাঁতার কাটিয়া এক বিরাট সাফল্য অর্জন করিয়াছে। ...শহরে নন্দীর ১৪ ঘণ্টাব্যাপী সাঁতার কাটিবার কথা ঘোষণা করিলে জনসাধারণের মনে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। ২২ আগস্ট সন্ধ্যা হইতে জোড় পুকুরের চারি পাড়ে লোকে লোকারণ্য হইয়া যায়। এমন কি বিপুল সংখ্যক মহিলাও ইহা উপভোগ করিবার জন্য উপস্থিত ছিল।’ অরুণ নন্দী লিখেছেন, ‘চাঁদপুরে আমি ছিলাম রাজার মতো। আমি যখন পথ চলতাম, তখন রাস্তার দুপাশের বাড়ি-ঘরের দরজা-জানালা খুলে যেত। আমাকে দেখার জন্য সবার মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি লেগে যেত।’

১৯৫৯ সালে চাঁদপুরে তিন মাইলের সাঁতার প্রতিযোগিতায় অরুন নন্দী প্রথম হন। একই বছর চাঁদপুর থেকে ঢাকা (৬০ মাইল) সাঁতার অনুষ্ঠিত হয়। অরুন নন্দী এতে দ্বিতীয় হন। তিনি ১৯৬৪ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর (৪২ মাইল), ১৯৬৬ সালে দাউদকান্দি থেকে চাঁদপুর (৩২ মাইল), ১৯৬৭ সালে ফরিদপুর (১৪ ঘণ্টা), ১৯৬৮ সালে কুমিল্লায় ৫৭ ঘণ্টা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫৩ ঘণ্টা, চাঁদপুরে ৫২ ঘণ্টা, নোয়াখালীতে ৩৬ ঘণ্টা, ১৯৬৯ সালে ফেনীতে ৪৮ ঘণ্টা, ’৭০ সালে বরিশালে ৪২ ঘণ্টা অবিরাম সাঁতার কাটেন। এসব সাঁতার তাঁকে সারাদেশে ব্যাপক পরিচিত করে তোলে।

অরুন নন্দীর বিখ্যাত কাজের একটি স্বাধীনতার জন্যে সাঁতার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। তখন একটানা সাঁতারের বিশ্বরেকর্ড ছিল আমেরিকান সাঁতারু বি সি মোর-এর দখলে। তিনি টানা ৮৯ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট সাঁতার কেটেছেন। অরুন নন্দী সিদ্ধান্ত নিলেন একটানা সাঁতারে তিনি বিশ্বরেকর্ড করার চেষ্টা করবেন। আর সাঁতার থেকে আয়ের অর্থ মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে প্রদান করবেন। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে দেখা করলেন কিংবদন্তী সাঁতারু ব্রজেন দাশের সঙ্গে। ব্রজেন দাশ রাজি হলেন। তাঁর অধীনে বৌবাজার জিমনেসিয়ামে প্রস্তুতি নিতে থাকলেন অরুন নন্দী। ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর সাঁতারের দিন নির্ধারিত হয়। কলকাতার চাঁদপুর সম্মিলনী, বৌ-বাজার ব্যায়াম সমিতি ও সুইমিং ক্লাব যৌথভাবে কলকাতা কলেজ স্কোয়ারের পুকুরে সাঁতারের আয়োজন করে। এর উদ্বোধন করেন কলকাতায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার হোসেন আলী। ম্যানেজারের দায়িত্বের ছিলেন ব্রজেন দাশ। উপস্থিত ছিলেন ভারতের সুইমিং ফেডারেশনের সভাপতি দিলীপ মিত্র, প্রথম নারী ইংলিশ চ্যানেলজয়ী আরতি সাহা, চ্যানেলজয়ী বিমল চন্দ্র, নিহির সেন প্রমুখ। এসময় বক্তব্যকালে অরুন নন্দী বলেন, ‘আমাদের মাতৃভূমি আজ শত্রুকবলিত। প্রতিদিনই আমাদের কারো না কারো জীবন ঝরছে। হিন্দু-মুসলিমণ্ডবৌদ্ধ-খ্রিস্টান কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমরা জানি না, আমরা কবে স্বাধীনতা পাব? তবে স্বাধীনতার জন্য আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। আমিও আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা থেকে এই সাঁতার করার উদ্যোগ নিয়েছি।...সাঁতারে বিশ্বরেকর্ড গড়ার জন্য আমি সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবো’ (চলবে)।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়