প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২৬
ধারাবাহিক উপন্যাস-১০
নিকুঞ্জ নিকেতন

(গত সংখ্যার পর)
কথাটা বলার সাথে সাথে জেনিফার চেয়ার ঠেলে ফেলে দিয়ে কিচেনে চলে যায়। ছেলে তখনো তর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। আমি বেহায়ার মতো সোজা নিজ কামরায় চলে আসি। অনেক রাত অবদি চেঁচামেচি চলতে থাকে। বিছানায় শুয়ে আছি কিন্তু ঘুম নেই। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ বালিশে এপাশ-ওপাশ করে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি টেরই পাইনি। টেনশনে থাকলে শুনেছি অনেকের ঘুম কম হয় আমার বেলায় সেরকমই ঘটেছিল। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় তখন ভোরের আজান দিচ্ছে। অনেক ট্রাই করেও ঘুমাতে পারিনি। তারপর ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়ি হাঁটতে। ভোরের আলো সবে মাত্র ফুটতে শুরু করল। রাস্তায় ঝাড়ুদার ছাড়া তেমন একটা লোক দেখছি না। মসজিদ থেকে মুসল্লিরা এখনো নামাজ সেরে বের হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে পার্কে চলে আসলাম। বাদাম গাছতলায় বেঞ্চিতে বসে বসে ভাবছি জীবনটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়। যেখানে আপনজনরাই আপন রইল না সেখানে আমার অবস্থান কোথায়? ভাবনায় এতটাই ডুবে গেছি যে কখন ঘণ্টাখানেক সময় পার হলো বুঝতেই পারলাম না। হঠাৎ কানে ভেসে আসল নরেন্দ্রদার আওয়াজÑ
‘কী হে পিটার আজ দেখি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি, তা কখন এলে?’
‘এইতো দাদা ভোরের আজান যখন দিল তখন।’
‘আরে কী বলছ এতক্ষণ তাহলে কী করলে।’
‘এখানেই বসে ছিলাম।’
‘ব্যপারটা কী বলো তো! তুমি কখনো তো এত ভোরে আস না।
‘কিছু না দাদা এমনিতেই।’
‘এমনিতেই না। কোথাও কোনো কিন্তু অবশ্যি আছে।’
আমি বুঝতে পারছি আবেগে আমার প্রচুর কান্না আসছে। এটা আড়াল করতে হবে নতুবা সকলের সামনে বিষয়গুলো খোলাসা হলে নিজেরই সম্মান হানি হবে। সন্তানদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলিনি নতুবা ওদের মধ্যে মনুষ্যবোধটা হারিয়ে গেল কেন? নরেন্দ্রদার কাছে আমার বলার কিছুই নেই তারপরও কেন যেন মন খুলে সবকিছু বলতে ইচ্ছে করে। মাথা নুঁইয়ে বসে আছি হঠাৎ দু ফোঁটা অশ্রু আমার সামনে পড়ল। বিষয়টা নরেন্দ্রদা লক্ষ্য করেছিল তারপর একপ্রকার জোর করলে আমি আমার মনের সকল কষ্টগুলো সামনে তুলে ধরি। কান্নাগুলোকে আর দমিয়ে রাখতে পারিনি। তিনিও
আমায় বললেনÑমন খুলে কেঁদে ফেল বুকের পাষান হালকা হয়ে যাবে। আমাকে সময় দেওয়া হলো আর আমিও নিজেকে বাঁধা দেইনি। সত্যি তাই, বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্টগুলো অশ্রু হয়ে যেন বের হয়ে গেল। ঝটপট চোখ মুছে কান্না লুকানোর চেষ্টা করছি কারণ সারোয়ার এসে দেখলে তুমুল কাণ্ড ঘটাবে। নরেন্দ্রদা আমাকে তেমন কিছুই বললেন না যেন বিষয়টা তার আমলেই আসেনি। না আসলেই ভালো কারণ পারিবারীক বিষয়ে তাদেরই বা কী করার থাকে।
‘পিটার চল একটা রাউন্ড দিয়ে আসি।’
‘চলুন দাদা। একটা কথা বলব?’
‘অনুমান করতে পারছি কী বলতে চাইছ। দেখ এটা একদিন অনিমেষকেও বলেছিলামÑপ্রতিটি মানুষের যুদ্ধ তার নিজেকে লড়তে হয়। আমরা যারাই আছি শুভাকাক্সক্ষী তারা বেশি একটা এগিয়ে আসতে পারব না যদি তুমি নিজে লড়তে না চাও। চিহ্নিত শত্রুকে পরাজিত করা যায় কিন্তু শত্রুর কাতারে যখন আপনজন থাকে তখন এটা অসম্ভব হয়ে ওঠে। জানো এই বিষয়ে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে সেই উপদেশটাই দিয়েছিলেন। একটু চেষ্টা করি ধর্মকর্ম করতে অর্থাৎ বেদ-গীতা পড়ি তাই কিছুটা জানি।’
‘জানেন দাদা, কয়েক মাস আগে এক বিকেলে দিঘি পাড়ের এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলাম। হটাৎ দেখি দিঘি পাড়ের শিমুল গাছটার নিচে এক রিকশা ড্রাইভার তার রিকশায় বসে মনের আনন্দে বিড়ি টানছে আর গলা হাকিয়ে গান তুলেছে। আশপাশ দিয়ে অনেকেই হেঁটে যাচ্ছে সেটাতে তার কোনো সাড়া নেই। আমি থেমে গিয়ে পাশের বেদিটায় বসে তার গান শুনছিলামÑ
“পর মানুষে দুঃখ দিলে দুঃখ মনে হয় না
আপন মানুষ দুঃখ দিলে মেনে নেওয়া যায় না।”
গানটা এর আগে কখনো শুনিনি তবে যতটুকু শুনেছি তাতে মনে হলো যেন গানের কথায় আমার জীবন বর্ণনা করছে। তার গায়েকিতে এত আবেগ ছিল যে তাতে সে পুরোপুরি মগ্ন। নিজের কান্না আমি ধরে রেখেছিলাম বহু কষ্টে। সেই লোকটা আমার জীবনের এই সময়টাতে কেন এমন একটা গান নিয়ে হাজির হলো বুঝতে পারিনি। গানটা শোনার পর দু-তিনদিন এটাতেই ডুবে ছিলাম। কথাগুলো যেন জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সাথে ওষ্টে-পিষ্টে জড়িত।
‘এটাকেই বলে নিয়তি। অজান্তেই জীবনের অনেক কিছু আমাদের সামনে চলে আসে যেটার প্রত্যাশাও কভু করা হয় না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের চলার পথে জীবনের প্রতিটি রূপকে সামনে তুলে ধরেন। হয়তো তুমি তার প্রিয় তাই তোমার চলার পথকে সুগম করার জন্য তিনি সাংকেতিক রূপে বহুকিছু তুলে ধরছেন।’
‘আপনার কথাগুলো বিশ্বাস করতে মন না চাইলেও বাস্তবতার সাথে মিলে যায়। অনেক সুন্দর করে ব্যখ্যা করতে পারেন।’
‘প্রসংশা করছ।’
‘না সত্যিটা বলছি।’
‘হা হা হা...’ [পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় দেখুন]