বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫৬

উচ্চবিত্তের ফল ড্রাগন কম দামে ভ্যানে করে বিক্রি!

কৃষিকণ্ঠ প্রতিবেদক
উচ্চবিত্তের ফল ড্রাগন কম দামে ভ্যানে করে বিক্রি!

‘ড্রাগন ১০০ টাকা, ড্রাগন ১৫০ টাকা। নিয়ে যান, মজা করে খান’। চাঁদপুরর বিভিন্ন বাজারের সামনে, রাস্তার পাশে ভ্যানে করে ফল বিক্রেতাদের এভাবে হাঁকডাক শুরু হয়। কেউ মুখে, কেউবা হ্যান্ড মাইকে স্বয়ংক্রিয় ভয়েস রেকর্ড চালিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন।

চাঁদপুর বাইতুল আমিন চত্বর মোড়ে, পাল বাজার, বিপণীবাগ, বাসস্ট্যান্ড, ডিসি অফিস এলাকায় ড্রাগন ফল নিয়ে বিক্রি করেন অনেকেই। ড্রাগন ফল কেনেন মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘বছর কয়েক আগে ড্রাগন কেনার সাহস করতাম না। এমনকি আশপাশেও যেতাম না। ৬০০ টাকা দিয়ে এক কেজি ড্রাগন কেনার কথা ভাবতেই পারতাম না। দাম ছিলো নাগালের বাইরে। এখন ১০০ টাকার মধ্যে পাই, তাই সন্তানদের জন্যে নিয়ে যাই।’

বছর তিনেক আগেও ড্রাগনকে মনে করা হতো ‘উচ্চবিত্তের ফল’। এই ফল কেজিতে বিক্রি হতো গড়ে ৫০০ টাকায়। ২০২৩ সাল থেকে ড্রাগন ফলের দাম কমতে শুরু করে। এখন কোথাও ৮০ টাকা, কোথাও ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন ফল বিক্রি হতে দেখা যায়।

পাল বাজারে দীর্ঘদিন ধরে ড্রাগন ফল বিক্রি করে আসছেন ফারুক সরদার। তিনি বলেন, ‘এ ফলের দাম কমতাছে বছরখানেক হইলো। আগে ৫০০ টাকা কেজি বিক্রি করতাম। এখন প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করি’।

কীভাবে দাম কমলো

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, গত তিন বছরে ড্রাগন ফলের উৎপাদন প্রায় ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১-২২ বছরে ১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ হয়। ড্রাগন ফল উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ৮৭২ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ সালে ২ হাজার ৫৮৮ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলের উৎপাদন দাঁড়ায় ৫১ হাজার ২৮৭ মেট্রিক টন। ২০২৩-২৪ সালে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮ হাজার ৮১৩ মেট্রিক টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. ময়নুল হক বলেন, ড্রাগন চাষে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ২০২৩ সালের দিকে ব্যাপকভাবে ওভার গ্রোথ হরমোনের ব্যবহার শুরু হয়। ফলে উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। তবে ঝুঁকির কারণে অনেক ক্রেতা ড্রাগন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ফলে ড্রাগনের দামে পতন ঘটে।

ওভার গ্রোথ হরমোন ব্যবহারের জন্যে বড়ো বাগানিদের দায়ী করেন ময়নুল হক। তিনি বলেন, যারা বড়ো পরিসরে ড্রাগনের চাষ করেন, তারাই মূলত এই ওভার গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করেন। ছোট চাষিদের জন্যে এই হরমোনের ব্যবহার লাভজনক নয়। এই হরমোন ভারত থেকে চোরাই পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এই হরমোনের ব্যবহার বেশি।

দেশে দুই পদ্ধতিতে ড্রাগনের চাষ হয় বলে জানান ময়নুল হক। তিনি বলেন, একটা প্রচলিত পদ্ধতি, আরেকটি চায়না পদ্ধতি। চায়না পদ্ধতিতে প্রতি বিঘায় ড্রাগনের উৎপাদন হয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কেজি। খরচ হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও প্রতি বিঘায় গড়ে এক লাখ টাকা লাভ থাকে উৎপাদনকারীর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ড্রাগন উৎপাদনের শীর্ষে আছে ঝিনাইদহ জেলা। এখানে গত অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৩২ হাজার ৭৬৮ মেট্রিক টন ড্রাগন। এরপরে রয়েছে যশোর জেলা। এখানে গত অর্থবছরে উৎপাদন হয় ১২ হাজার ৫৫৩ মেট্রিক টন ড্রাগন। আর তৃতীয় শীর্ষ জেলা রাজশাহীতে উৎপাদন হয় ৪ হাজার ৪৭৭ মেট্রিক টন ড্রাগন।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ছুরত আলী ২০১৭ সাল থেকে ড্রাগন চাষ করেন। তিনি বলেন, যখন শুরু করেন, তখন তার এলাকার খুব বেশি মানুষ ড্রাগন চাষ করতেন না। ধীরে ধীরে চাষিদের সংখ্যা অনেক বাড়ে। বাড়ে উৎপাদনও। আগে এক বিঘা জমিতে উৎপাদিত ড্রাগন প্রায় ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করতেন। এখন তা কমে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকায় চলে এসেছে।

ড্রাগনের উৎপাদন বাড়ায় দাম কমেছে বলে মনে করেন ছুরত আলী। ‘ওভার গ্রোথ হরমোন’ সম্পর্কে (যা টনিক নামে চাষিদের কাছে পরিচিত) জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটার ব্যবহার কয়েক বছর আগে শুরু হয়েছে। লাভ বেশি করার লোভ থেকে এটা ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এটার কারণে ড্রাগন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার জানা মতে, বাজারে যে ফল দেখতে অর্ধেক সবুজ ও অর্ধেক লাল, সেগুলোতে টনিক ব্যবহার করা হয়েছে।

দেশে কীভাবে এলো ড্রাগন ফল

বাংলাদেশে কীভাবে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষিবিষয়ক প্রকাশনা ‘কৃষি বাতায়ন’-এ বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম থেকে বিভিন্ন জাত এনে বাংলাদেশে ড্রাগনের চাষাবাদ শুরু হয়। তবে কার হাত ধরে বাংলাদেশে ড্রাগনের চাষ শুরু, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখানে নেই।

অবশ্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মসিউর রহমান বলেন, ২০০২-২০০৩ সালে এই ইনস্টিটিউট ড্রাগনের একটি জাত উদ্ভাবন করে। এখন সেটিরই সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক চাষ হয়। এ জাতের ফল মাঝারি, মিষ্টি। উৎপাদনও ভালো হয়।

কার হাত ধরে কীভাবে ড্রাগনের চাষ দেশে ছড়িয়ে পড়লো, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে পারেননি মসিউর রহমান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, সংস্থার সাবেক পরিচালক এস এম কামরুজ্জামান ড্রাগন চাষ নিয়ে কাজ করেছিলেন। ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়া কামরুজ্জামান বলেন, ২০০৯ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায় থেকে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো, দেশে ড্রাগন চাষ করতে হলে কী করতে হবে। তখন তিনি করণীয় বলেন। পরে তাঁকে ভিয়েতনাম থেকে চাষপদ্ধতি শিখে আসতে পাঠানো হয়। তিনি ভিয়েতনামে গিয়ে ড্রাগনচাষিদের সঙ্গে ৯ দিন কাটান। তাঁদের কাছ থেকে চাষপদ্ধতি ভালোভাবে রপ্ত করেন। চাষিদের ক্ষেতে থাকা বিভিন্ন জাতের ড্রাগন খেয়ে দেখেন। যেগুলোর স্বাদ বেশি—এ রকম পাঁচটি জাতের ড্রাগনের এক ফুট দৈর্ঘ্যের ৬০টি কাটিং (ড্রাগন গাছের একটি অংশ) নিয়ে দেশে ফেরেন। দেশে সফলভাবে চারা করেন। ২০১৩ সালের দিকে ‘মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পে’র অধীনে সারা দেশে ড্রাগনের এক লাখ চারা দিয়ে এক হাজার প্লটে প্রদর্শনী করেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়