শনিবার, ০৯ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫৬

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
নিকুঞ্জ নিকেতন

রাস্তার অপর পাশ থেকে বাড়িটার দিকে তাকালে মনে হয় আমাদের কত পরিচিত, আপনজনের মতো। একটা লোহার গেট, সেটা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই প্রশস্ত একটা পথ যার দু পাশে কিছু ফল ও ফুলের বাগান। যদিও পুরাতন তবু এই শহরের সুউচ্চ অট্টালিকাগুলোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। পুরাতন বাড়ি যেগুলো ছিল প্রায় প্রতিটি বাড়িই আধুনিকায়নে নতুন রূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে কিন্তু নিকুঞ্জ নিকেতন সেই আদিকালের অস্তিত্বকে আগলে টিকে রয়েছে নাগরিক জীবনে। বাড়িটা পূর্ব পুরুষের স্মৃতি বিজরিত তাই এটাকে আর নতুন করে গড়াইনি। পুরাতন কোনো কিছু বেশিদিন টিকে থাকে না তাকে বিবর্তিত হতে হয়। পুরানো দিনের মানুষগুলোর সাথে এখানেই একটু ঝামেলা হয়ে যায় কারণ আমরা বিবর্তন চাই না, চাই না আমাদের সময়কার কোনো কিছু বদলে যাক। প্রবীণরা যতই পুরাতন হই না কেন চেষ্টা করি আজকের সময়েও নিজেদের ধরে রাখতে কারণ আমরা বুঝতে পারি মায়ার এই পৃথিবীতে আর বেশি দিন নেই, সময়টা ফুরিয়ে আসছে। এক এক করে যখন সবই ছুটে যাচ্ছে তখন প্রাণটাও দেহ থেকে কোনো একদিন ছুটে যাবে। আমাদের সময়কার পুরানো কিছু যখন পাল্টে নতুন করে গড়ে দেওয়া হয় কেন যেন মেনে নিতে পারি না কারণ সেটাতে তখন আর আমরা থাকি না, থাকে না আমাদের স্মৃতি, অনুভূতি, ছোঁয়া। আমারই কোনো কিছু যখন গড়ে ওঠে নতুন করে সেটা তখন আমার থেকে বদলে হয়ে যায় পর। নতুন আর পুরাতন প্রজন্ম যে যার মতো করে টিকিয়ে রাখতে চায়। প্রবীণ চায় আগলে রাখতে যা কিছুই সে অর্জন করেছে আর নবীণ সেটাকে বদলে দিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গড়ে তুলতে চায়। না চাইতেও যেন একটা সমাপ্তি আর অন্যদিকে প্রাপ্যতা, দুটোতেই চলে নীরব যুদ্ধ। কথাগুলো আমার ডায়েরিতে লিখে রাখতে হবে নতুবা ভুলে গেলে আর মনে আসে না। আমাদের প্রত্যেকেরই তার নিজ অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করা উচিত কারণ মানুষের মধ্যে অন্যকে বুঝে নেওয়ার সেই দক্ষতা এখন আর নেই। সকলে ছুটতে ছুটতে এতই গতিশীল যে কাউকে ভাবার মতো সে সময়টুকু নেই। যান্ত্রিকতায় অনুভূতিগুলো যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে।

‘নরেন্দ্র দা আমরা মানুষ তো তিনজন এখন আরেক পার্টনার কোথায় পাই বল তো? নাহ্ পিটারকে নিয়ে আর পারলাম না। গতবারই বলেছিলাম আড্ডায় সময়মতো চলে আসো দেখবে জীবনের রূপ পালটে যাবে। সারাদিন সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকলে একটা মানুষ বাঁচে কীভাবে?’

‘সারোয়ারÑযে ঝামেলা পোহায় একমাত্র সে বোঝে এর ব্যথা কতটুকু। এটা ক্যানসারের চাইতেও ভয়াবহ বুঝলে। না পারে বলতে না পারে সইতে। আমি এমনি কিছু একটা সহ্য করেছি কিছু আগে তাই বুঝি।’

‘তা ঠিকই বলেছ অনিমেষ। পঁচে যাওয়া সবজি দিয়ে আর কতটুকুই বা বেঁছে নিয়ে রান্না করতে পারবে।’

‘বাহ্ চমৎকার বললে সারোয়ার। তুমি তো সাহিত্যিক হয়ে গেলে দেখি।’

‘আরে কী বলÑসত্যি! বইটা তাহলে লিখে ফেলব?’

‘হা হা হা...’

‘আমি একটা সমাধান দিতে পারি তোমাদের।’

‘কী?’

‘আজ ক্যারাম বাদ দিয়ে তোমরা দাবায় কেন নিজেকে জাহির করছ না? নাশতার পর একটা ম্যাচ সেরে না হয় পরবর্তীটা ভাবা যাবে।’

‘বেশ আমরা তাহলে দাবায় লড়ব আর তুমি কী করবে?’

‘আমার তো সঙ্গী আছেই-ডায়েরিটা নতুবা বাগান। তোমরা দুপুরে আমার বাসায় লাঞ্চ সেরে নিও। আমি কাজের লোককে তোমাদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করতে বলে দিচ্ছি।’

নাশতার পর ওরা চলে গেল দাবার আড্ডায় আর আমি ডায়েরিটা নিয়ে বসে গেছি। এভাবে লিখতে গিয়ে ডায়েরি অনেক জমেছে কিন্তু কখনো পড়া হয় না শুধু লিখেই যাই। ডায়েরি লেখা একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র এটায় কোনো সুফল আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য একটা উপলক্ষ্য বা মাধ্যম প্রয়োজন। ডায়েরি সেই নীরব বন্ধুর কাজটা করে যেখানে মন খুলে লিখা যায়। ভাবনার কথাগুলো সবসময় চেষ্টা করি লিখে নিতে। কোনো ভাবনা ছুটে গেলে কষ্ট লাগে। ভাবনাগুলো মাথায় আসে আর এটাকে মনে কিছু সময়ের জন্য বিশ্লেষণ করলাম তারপর শুণ্যে হারিয়ে গেল তাকে আর খুঁজে পাই না, শত চেষ্টায়ও না। মনটা তখনি বিষণ্ন হয়ে ওঠে আর মাথায় প্রেসার দিতে থাকিÑমনে পড়ুক, পড়তেই হবে, পড়া উচিত কিন্তু আর মনে পড়ে না। এতসব ব্যর্থতার মাঝে তখন আরেকটা বাড়ে। একা থাকি তো তাই ভাবনাগুলো ছাড়া আমার কাছে আর কোনো আপনজন নেই। মাঝে মাঝে আমি গাছের সাথে কথা বলি কারণ মনের অভিব্যক্তিগুলো কাউকে বলতে হয়। বুকের ভিতর কত কিছু জমা থাকে সেগুলো জানাতে হয় তখন বুকটা হালকা লাগে। আজ ওদের নিয়ে এসেছি নিজের শূন্যতা ঘুচাতে। সারোয়ার একটা মজার মানুষ সে পাশে থাকলে নিজেকে কখনো শূন্য মনে হয় না। ষাট বছর বয়সেও যেন পঁচিশের চঞ্চলতা ধরে রেখেছে। আমার জীবনটা এখন এই চারজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ করেছি। ছেলেটা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পর বড় একা হয়ে যাই আবার অবসরটাও ছিল আমার ঘাতক ব্যথার মতো, পেরে উঠছিলাম না কিছুতেই। ভাবছিলামÑশেষ কী হয়ে গেল জীবনটা কিন্তু প্রাণ তো আছে তাহলে বেঁচে থাকতে সমস্যা কোথায়? নাগরিক জীবনটায় কারো কাছে সময় নেই অন্যকে একটু সময় দেওয়ার। লাখো জনতার ভীড়েও যেন প্রতিটি মানুষ একা। একদিন হঠাৎ মনে ভাবনার উদয় হয়Ñএভাবে নেতিয়ে গেলে লাভ নেই, বেঁচে থেকেও বারবার মরতে পারব না। অবসর মানে জীবনের একটা অধ্যায় শেষ, জীবন নয়। তখনি জীবনের শেষ অধ্যায়টা নতুন করে আবার শুরু করেছিলাম। আমাদের চারজনকে দিয়েই শুরু হয় নতুন পথচলা আর পরিচয়টাও হয়েছিল এই পার্কে। প্রায়ই আসতাম এখানে এবং হর-হামেশা খুঁজতাম কাউকে একটু প্রাণ খুলে কথা বলার জন্য। বুকের ভিতর জমা অনেক কথা যা জমতে জমতে স্তূপাকারে ওজন বাড়াচ্ছে। একটু ভরসার কাউকে পেলে কথাগুলো বলে তার ওজনটা কমাতাম। আশপাশের অনেকেই আছে কিন্তু ভরসা পাই না। কেন, সেটা জানা নেই। সেদিন প্রথম পরিচয় হয় অনিমেষের সাথে। দেখি পার্কের বেঞ্চিতে একটা লোক জড়সড়ো হয়ে বসে আছে যেন তার দেহ এখানে অথচ সে আছে অন্য কোথাও। আশপাশের এত শোরগোল মানুষের আনাগোনা কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছে না। ধীরে ধীরে তার কাছে যাই, পাশে বসার জন্য অনুমতি চাইলে শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। তারপর আবারও ডুবে যায় তার নিজ জগতে। তাকে বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ্য করলাম কিছুই বুঝতে পারলাম না। অবশেষে কথার পর্বটা আমাকেই শুরু করতে হয়েছিল।

‘নমষ্কার-আমি নরেন্দ্র নারায়ণ দাস।’

আমার কথায় যেন তার টনক নড়েনি আবার তাকে একইভাবে নিজের নাম প্রকাশ করলাম। হঠাৎ এক প্রকার চমকে উঠে বলছেÑআমাকে কিছু বললেন? কিছুক্ষণ থেমে তারপর নিজের নামটা পুনরায় বললাম। মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বেশ কিছু পর বলেÑ

‘অনিমেষ ঘোষ’।

‘প্রতিদিন আসা হয় আপনার?’

‘না...মাঝে মাঝে তবে এখন থেকে প্রতিদিনই আসার চেষ্টা করব। এখানে আসলে ভালো লাগে। রিটায়ার লোক তো তাই করার মতো তেমন কিছু নেই। নাতি-নাতনিদের স্কুলে দিয়ে এখানে আসি আবার ছুটি হবে ঘণ্টা দেড়েক পর তখন তাদের নিয়ে বাসায় চলে যাব। আপনি?

‘আমিও আপনার মতো একজন। চাকরি শেষে এখন অবসরে সময় কাটাই। নিজের দেখাশোনা নিজেই করি।’

‘তাহলে আপনার পরিবার?’

‘একটা মাত্র ছেলে আর কেহ নেই। গিন্নি মারা যায় ছেলেটার বয়স যখন দশ। তারপর বাপ-ছেলে দুইজনের সংসার এভাবেই কাটাতে থাকি অনেক বছর। চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় ঘোরা হয়েছে। ছেলেটাকে নিয়েই গড়ে ওঠে আমার জীবন। ছাত্র ভালো তাই সকল মনোনিবেশ ছিল তাকে গড়ে তোলার। আমরা বাবা-মায়েরা সন্তুানদের জন্য কিছু করতে কার্পণ্য বোধ করি না কভুও, তাই না?

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়