শনিবার, ০২ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৩৮

ধারাবাহিক উপন্যাস নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
ধারাবাহিক উপন্যাস নিকুঞ্জ নিকেতন

বাক্যটা ছিল শেষ ভালো যার সব ভালো তার। জীবনের শুরু বা মাঝামাঝি অংশ ভালো হলেও শেষটা কী আদৌ ভালো হয়! যদি হয়ে থাকে তাহলে শতাংশে তা কতটুকু? মানবজীবন এক বিভীষিকাময় রহস্য, যার অঙ্কের হিসেব কষা হয় একরকম আর সমাধানটা অন্যরকম। বিচিত্র এক জীবনধারা বিচিত্র তার রূপ। শৈশব-কৈশর কাটিয়ে বয়সটা প্রৌঢ় ছঁুতেই দায়িত্ববোধের বোঝা, চাপ, সহনশীলতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে এগিয়ে যেতে হয় ঠিক রেলগাড়ির মতো যেখানে দায়িত্বশীল ব্যক্তিটা ইঞ্জিন আর নির্ভরশীলরা তার বগি। ইঞ্জিন দুর্বল হলেই তার উপর নির্ভরশীলরা পিছিয়ে পড়বে তাই তার থেমে যাওয়া চলবে না ছুটতে হবে অবিরাম একের পর এক এদিক-ওদিক। লোকে বলে বঁাচার তাগিদে জীবনের সকল আয়োজন আমার কাছে বিষয়টা সেরকম মনে হয় না। আমরা একদিন মারা যাব এবং মৃত্যুর আগে সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে যেতে হবে এজন্যই জীবনের সকল আয়োজনগুলো। বেঁচে থাকা প্রতিদিন কতটা সত্য তা জানা নেই তবে একদিন মৃত্যু সেটা ধ্রুব সত্য। আমরা সারাজীবন এটা থেকে পালিয়ে বেড়াই। একদিকে জীবনটা লালসা দিয়ে আমাদের আগে ছুটে চলে আমরা ছুটি তার পিছনে আবার অন্যদিকে মৃত্যুটাও একই গতিতে ছুটে বেড়ায় আমাদের পিছনে। এভাবে ছুটতে ছুটতে প্রতিযোগিতায় ক্লান্তিতে একটা সময় হঁাপিয়ে উঠি, গতি কমে যায় তারপর ধীরে ধীরে জীবনটা অনেক দূরে যেতে থাকে অন্যদিকে মৃত্যুটা কাছে আসতে আসতে হঠাৎ ছুঁয়ে যায় আর আমরা আউট হয়ে যাই। আগে ছুটে গিয়ে তখন জীবনটা জিতে যায় আবার আমাদের ছঁুয়ে মৃত্যুটাও একইভাবে জিতে যায় শুধু হেরে যাই আমরা মানুষগুলো। পার্কের বেঞ্চিতে বসে ভাবনাগুলো যেন ডানা মেলেছে।

নগরীর পার্কগুলো শেষ বয়েসি মানুষের জন্য আপনজনের মতো। এটা এমন একটা স্থান যেখানে নিজেকে অকেজ মনে হয় না। আশপাশের সকলেই যান্ত্রিক আর এই পার্ক আমাদের মতো শেষ বয়েসিদের কাছে পুনরায় নিজেকে ফিরে পাওয়ার একটি উপকরণ। পার্কের অলস বেঞ্চিতে বসে জীবনকে মেপে নেওয়া যায়, ভেবে নেওয়া যায় নিজেদের মতো করে। কর্ম থেমে গেলেও জীবন তো আর থেমে থাকে না। বিরামহীন গতিতে বয়ে চলে আদি থেকে অন্ত। মানব জীবনের শেষ যে ধাপ আছে তাকে আমরা বার্ধক্য বলি। যেখানে সারা জীবনের সঞ্চিত কত কিছুই ধীরে ধীরে অপরিচিত হয়ে ওঠে। এ বয়সটাতে চোখের দৃষ্টি শক্তি কমে যায়, কর্মক্ষমতা, মেধা, মননশীলতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি বহু কিছু থাকে না আর যা থাকে সেটা হলো সারা জীবনের অভিজ্ঞতা, একটা অলস বেঞ্চি, কিছু প্রেসক্রিপশন ও বোঝাই করা একটা ওষুধের বাক্স। একটা খেতাবি নাম জুটে সোসাইটিতে যাকে বলা হয় প্রবীণ। নবীনদের সাথে প্রতিযোগীতায় এই প্রবীণটা যেন হঁাপিয়ে উঠে আর তখনি ঘটে আসামঞ্জস্যতা। নবীন আর প্রবীণদের মাঝে একটা ব্যবধান থাকবে এটা অস্বাভাবিক কিছু না তারপরও কোথাও যেন কিছু একটা মিলে না আর তাই মানিয়ে নেওয়াটা হয়ে ওঠে অপ্রতুল। কখনো মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা মানুষটা শেষ বয়সে এসে কেমন যেন নিজেই নিজের কাছে নুয়ে পড়ে। সত্ত্বাটা তখন এমনভাবে ক্ষয় হতে থাকে যেন তার অস্তিত্বে মরিচা পড়েছে। একটা সময় কাউকে যখন আশীর্বাদ দিতে শুনতামÑআয়ুস্মান ভব ভব : অর্থাৎ দীর্ঘজীবি হও তখন মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠত কিন্তু বয়সের এই সন্ধিক্ষণে আজ বুঝি এটা আশীর্বাদ না। জীবন দীর্ঘ হওয়া অনুচিত কারণ শেষ বয়সে মানুষগুলো দায়িত্বের ঝুলি ফেলে দিয়ে অসহায়ত্বের বোঝা চাপিয়ে নেয়। এক সময়ে অর্জিত অর্থ-সম্পদ, প্রতিপত্তি সবকিছুই কেমন যেন এক এক করে স্থানান্তরিত হতে থাকে অন্য হাতে তারপর আগলে রাখা আপনজনের কাছেই নিজেকে মনে হয় অসহায়। শ্রীমদ্ভগবদগীতার তথাকথিত প্রবচনটা তখন বাস্তবতার রূপ নেয়Ñ“আজ যা তোমার আছে তা পূর্বে অন্য কারো ছিল আর আগামীতে হবে অন্য কারো, পরিবর্তনই জীবনের নিয়ম”। থাক এসবÑএমনটা কেন ভাবছি? এগুলো ভাবলে মন কেমন যেন ভারী হয়ে ওঠে।

‘কী হে নরেন্দ্র দা চলে আসলে তাহলেÑতা বাকি সব কোথায়?

‘আসবে এক এক করে হয়তো।’

আজ পিটারের কাছ থেকে তার বিষয়ে শুনতে হবে।’

‘কী লাভ হবে শুনে। পরিবারগুলোর তো এটা নিত্য বিষয়, আমাদের তাতে মাথা না ঘামালেই ভালো।’

‘মাথা না ঘামাতে চাইলেও ঝামেলা তো আর শেষ হবে না। তাছাড়া সমস্যাগুলোর সমাধান প্রয়োজন।’

‘অনিমেষ আমাদের জীবনে প্রত্যেকের লড়াইটা তার নিজেকেই লড়তে হয়। আমরা প্রতিটি মানুষ একজন যোদ্ধা বুঝলে।’

‘ওহে দাদারা- তোমাদের দেরি দেখে আমি নিজেই এক রাউন্ড শেষ করলাম, একটু বসে নেই তারপর একসাথে আরেক রাউন্ড দিয়ে আসব।’

‘আরে নাম না নিতেই বান্দা হাজির, তা অনেকদিন বঁাচবে সারোয়ার।’

‘নরেন্দ্র দা, আমাকে কভুও এ কথা আর বলবে না। জীবনটাকে আর বয়ে বেড়াতে চাই না এখন শেষের পালা আর ভালো লাগছে না। বেঁচে থাকা কেমন যেন অভিশাপের মতো মনে হয়। যতক্ষণ বাইরে থাকি ততক্ষণ নিজেকে আগলে রাখি তারপর যখন আপনজনদের কাছে পেঁৗছি কেমন যেন খাপ খাইয়ে নিতে পারি না আর পারি না বলেই নিজেকে বড় বেশি অকেজ মনে হয়। মনে হয় এই রাস্তার পাথরটাও আমার চেয়ে একটু দামি’।

‘আজকাল কী মিলছে না পরিবারে অন্যদের সাথে?’

‘বিষয়টা মিল অমিলের না’।

‘তাহলে?’

‘আত্মসম্মানের, নিজস্ব সত্তার। অবসরের পর ভেবেছিলাম ছেলে-মেয়েদের নিয়েই কাটিয়ে দিব বাকি জীবন। ছেলে-মেয়েরা যেভাবে মূল্যায়ন করছে আগামীতে এভাবেই কেটে যাবে কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।’

‘চলো ওঠোÑশেষ রাউন্ডটা দিয়ে চলে যাই বাসায়।’

‘এত তাড়া কেন, বাসায় কোনো আয়োজন হবে মনে হচ্ছে?’

‘কোথায় রে ভাই এখন কী আর সেই বল আছে। বয়স ষাটোর্দ্ধ, এ বয়সে দেঁৗড়-ঝঁাপ হয়ে ওঠে না। জীবনটা এখন প্রেশক্রিপশনের পাতা গুনে বুঝলে সারোয়ার।

‘হা হা হা... বেশ বললে দাদা, ছেলে-মেয়ের চাইতে ওষুধের বাক্সটা এখন বেশি আপন মনে হয়।’

‘তোমাদের সাথে থাকলে সত্যি একদিন হার্ট অ্যাটাকে মারা যাব। কী সব আবোল-তাবোল বল দেখি।’

‘আরে অনিমেষ এটাই বাস্তবতা বুঝলে। অবসরে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমার সময়টা ফুরিয়ে গেছে। জানো নরেন্দ্র দাÑএকটা সময় কাজ করতে করতে হঁাপিয়ে উঠতাম আর ভাবতাম কয়েকদিনের জন্য যদি পালিয়ে যেতে পারতাম। কোনো কাজ থাকবে না, টেনশন থাকবে না শুধু বিশ্রাম আর বিশ্রাম কিন্তু চাকরিটা যখন অবসর দিয়ে দিল এখন আর ভালো লাগে না। রাস্তায় যে লোকটা ঝাড়– দিচ্ছে পারি না তার হাত থেকে নিয়ে আমি নিজেই শুরু করে দিই। অবসর সত্যি একটা অভিশাপ বুঝলে।’

‘হুম...বুঝতে পেরেছি বার্ধক্য চেপে বসেছে তোমাদের, তা ডাবের জল খাবে নাকি? খেলে আমার সাথে এসো তারপর আমরা ফিরব আমাদের আশিয়ানায়। আগে রাউন্ড শুরু করি, আচ্ছা আমাদের আরেক পার্টনার কোথায়?

‘সে তো বরাবরই দেরি করে। শুনেছি ইদানীং নাকি তার হঁাটুর ব্যথাটা বেশ বেড়েছে। গতকালকেও তো আসেনি। একটাবার গিয়ে দেখে আসবে না কি?’

‘ইচ্ছে তো আছে কিন্তু তার পরিবারের অবস্থা জানই। পরিবারের লোকগুলো বড্ড পীড়া দেয় লোকটাকে। বয়সের কারণে সে জীর্ণ, অকেজ এটা বারবার বলে বুঝাতে হবে? পরিবারের জন্য কী একসময় এ মানুষটা কিছুই করে নাই?’

‘রাউন্ড আর দিবে নাকি ডাব খাবে এখন?’

‘ডাব খাই তারপর একটু জিরিয়ে ফিরে যাই।’

‘ভাই তিনটে ডাব দাও তো। আমরা বেঞ্চিতে বসি তুমি কেটে সেগুলো নিয়ে আস, এই নাও টাকা।’

‘জি স্যারÑআপনেরা বইয়েন আমি আনতাসি।’

ডাব খাওয়া আমাদের প্রায়ই হয় তাই পছন্দটা ডাবওয়ালা জানে। ডাবে শঁাস থাকতে পারবে না শুধুই জল। আমরা প্রতিদিনই চেষ্টা করি কিছু না কিছু করতে নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য। শেষ বয়সে বন্ধু জোগানো খুবই কষ্টকর। ভাগ্যগুনে তাদের পেয়েছিলাম নিজের মতো করে। এই বয়সে ডানপিটে ভাবটা আমাদের হয়ে ওঠে না তবুও চেষ্টা করি। প্রাণ আছে তাই বেঁচে থাকা যাকে বলে।

‘সারোয়ার তোমার সময় আছে, নাকি বাসায় ফিরবে?’

‘কেন বলো তো?’

‘ভাবছিলাম আজ একটু আড্ডাবাজি করি নরেন্দ্রদার ওখানে।’

‘আরে বলে কীÑভেবে নিয়েছ যখন পার্টনার তাহলে হয়ে যাক চারজনের এক ম্যাচ।’

‘কিন্তু পিটার তো আজও আসেনি। হয়তো বাসায় আবার নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়েছে।’

‘নরেন্দ্র দা আমার মনে হয় তার বিষয়ে আমাদের একটা কিছু করা প্রয়োজন। লোকটা আপনজনের কাছেই কেমন যেন নরক যন্ত্রণায় ভুগছে। তার সন্তানগুলো সত্যি অমানুষ। নিজের অবিভাবককে কেউ এভাবে হেলাফেলা করে!’

‘কী করবে? বিষয়টা পারিবারিক তাই বাইরের কেউ কিছু বললে বা এগিয়ে এলে কেমন যেন অশালিন দেখায়। তাছাড়া পিটারও তেমন কোনো প্রতিবাদ করছে না সবই তো সহ্য করছে।’

‘তোমাদের ভদ্রতা নিয়ে তোমরা থাক আমি কোনো একদিন ঠিকই গিয়ে হাজির হব প্রয়োজনে ওয়ার্ড কমিশনারকে জানাব।’

‘তোমার কী মনে হয় সারোয়ারÑতাদের ওয়ার্ড কমিশনার কিছুই জানে না! সবই জানে, পিটার যদি কাউকে কিছু বলতে না চায় তাহলে কেউ প্রতিবাদ করতে আসবে না কারণ বিষয়টা পারিবারিক আর পিটার এখন তার সন্তানদের উপর নির্ভরশীল।’

‘নরেন্দ্রদার কথার সাথে আমিও একমত পোষণ করছি। আমরা কিছু একটা করতে গেলেই পিটার সামনে এসে বঁাধা দিবে। সন্তান যতই খারাপ আচরণ করুক কোনো বাবা চাইবে না অন্য কেহ তাদের কিছু বলুক।

‘যাক বলতে বলতে চলে এলাম আমাদের প্রাণের ঠিকানায়Ñনিকুঞ্জ নিকেতন।’

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়