মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৭

শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ ও করণীয়

মো. সিদ্দিকুর রহমান
শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ ও করণীয়

অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত না করার ফলে শিক্ষার প্রায় সকল স্তরে শিক্ষার্থীর হার ব্যাপক ভাবে কমেছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর বিভিন্ন উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তৃণমূলের সাধারণ মানুষের সন্তানদের অবৈতনিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হলেও, এ নিয়ে চলছে রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের নানা ষড়যন্ত্র তথা অবহেলা। তাদের কার্যক্রমে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। শিক্ষক সংকটসহ নানা অব্যবস্থার মাঝে প্রাথমিকে ৩২ হাজার প্রধান শিক্ষক পদ দীর্ঘসময় থেকে শূন্য। মন্ত্রণালয় যথাযথ সমস্যার সমাধান না করে শিক্ষকদের হাইকোর্টে যেতে বাধ্য করে। মামলা দ্রুত শেষ করার কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। কত রাজনৈতিক মামলা জনস্বার্থে স্বল্প সময়ে শেষ হচ্ছে। শিশু শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে , অথচ এ মামলা নিয়ে মন্ত্রণালয় অনেকটা নির্বাক।

রাষ্ট্রের অবহেলার কারণে শিশু শিক্ষার সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। অপরদিকে প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর মাত্রাধিক পাঠদান বহির্ভূত চাপ। কিন্ডারগার্টেন, উচ্চ বিদালয়, কলেজ, এমনকি পি টি আই পরীক্ষণ বিদ্যালয় মোটেই নেই। এ পাঠদান বহির্ভূত অসংখ্য কাজের চাপ সৃষ্টিকর্তার তাদের ওপর অপরিসীম দয়া। এ দয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে তৃণমূলের গরীব মানুষের সন্তানদের লেখাপড়া। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে। এ কমার কারণ নির্নয় করে চ্যালেঞ্জ দূরীকরণের ভাবনা সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নেই। শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে, লেখা পড়া হয়না এ বক্তব্য রেখে প্রাথমিক শিক্ষকদের হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে থাকেন তারা।স্কুল সাপ্লাই

প্রথমত, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝরে পড়ার কারণ নিয়ে আলোকপাত করছি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা অবৈতনিক হলেও দারিদ্র্যতার কারণে মাধ্যমিকে শিশুরা ঝরে পড়ছে। সরকারি উপবৃত্তির টাকা বর্তমান সময়ে অতি নগণ্য। এর ফলে শিশুশ্রমে তারা যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া তারা পরিবারকে নানাকাজে সহযোগিতা করে অর্থ উপার্জন করে থাকে।

ঝরে পড়া কমানোর করণীয়

১। পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সময় কমিয়ে আনা। সময়সীমা সকাল ৯টা থেকে ১২/১টা সর্বোচ্চ ২টা করা প্রয়োজন। যাতে শিক্ষার্থীরা পারিবারিক কাজে তথা অর্থ উপার্জন কাজে সহযোগিতা করতে পারে।

২। উপবৃত্তির পরিমাণ বর্তমান সময়ের সাথে মিল রেখে বৃদ্ধি করা দরকার। হতদরিদ্র পরিবারের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, আটা ইত্যাদি বিদ্যালয় থেকে স্বল্প বা বিনামূল্যে প্রদান করে আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়তা করা যেতে পারে।

এবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কমা নিয়ে আলোকপাত করছি

শিক্ষার্থী কমার কতিপয় কারণ

জনগণের জ্ঞান নির্ভর শিক্ষা নিয়ে অজ্ঞতা : সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষা হলো শিশুর বয়স রুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী। শিশুর শারীরিক, মানসিক ও মেধার বিকাশে মনোবিজ্ঞান সম্মত জ্ঞান এর গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ আমাদের বেশিরভাগ মানুষের চিন্তা পরীক্ষা নির্ভর। শিশুরা এসব বুঝতে পারেনা, তারা মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় অনেকটা বমি করে দিয়ে বেশি নম্বর পাওয়াকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। এতে শিক্ষার্থী জ্ঞানে সমৃদ্ধ না হয়ে উপরের শ্রেণিতে বেড়ে উঠে। দেখা গেছে উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ফাইভ পেয়েও অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না।

শিক্ষার এ নাজুক অবস্থার জন্য জনসাধারণের বোধগম্যতার অভাব দায়ী। পাশাপাশি যত্রতত্র বেসরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠাসহ সরকারি বেসরকারি উচ্চ বিদালয়ের প্রাথমিক শাখার জন্য শিক্ষার এই বেহাল দশা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষ করে যে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা বই আছে, তা শিশুর কায়দা , আমপারা, ছোট ছোট সূরা, নামাজ শিক্ষা, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত, মোটামুটি ছোট শিশুদের নৈতিক শিক্ষা গড়ে দেওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় ও নীতি শিক্ষার বই আছে অথচ গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়না। যথাযথভাবে পড়ানো হলে আমাদের শিশুরা মক্তবের কায়দা , আমপারা ,নামাজ, রোজা হজ্জ্ব, যাকাতসহ নানা ধর্মীয় জ্ঞান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পেতে পারে।

বিশদভাবে কোরআন শিক্ষা মাধ্যমিকে দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় শিক্ষায় যথাযথ জ্ঞান আহরণ করতে পারবে। অথচ প্রাথমিক, মাধ্যমিকসহ সকল পর্যায়ে আমাদের ধর্মীয় শিক্ষাকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। আমাদের সর্বস্তরের মানুষের বদ্ধমূল ধারণা ধর্মীয় শিক্ষা হবে মক্তবে, বাড়িতে হুজুর এনে বা মাদ্রাসায় শিখতে হবে। মাদ্রাসায় ব্যাপক ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আলেম হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ধর্মীয় শিক্ষার বই থাকার পরেও ঠিকমতো শিক্ষা দেওয়া হয়না। এ জন্য রাষ্ট্র দায়ী। সপ্তাহে ২দিন ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাস থাকে। তাও আবার ছুটির আগে কম সময়। ছুটির পূর্বে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক শরীর ক্লান্ত থাকে। সকলে যাওয়ার মোহে অনেকটা বিচলিত থাকে। ঐ সময় এ পাঠে কেহই মনোযোগ দিতে পারেনা। অপরদিকে স্বাভাবিকভাবে নানা কারণে শেষ পিরিয়ড হয় না। যার ফলে ধর্মীয় ক্লাস থেকে শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয়ে থাকে।

ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা কার্যকর করার জন্য প্রথম বা বিরতি পূর্বে সপ্তাহে কমপক্ষে ৩ দিন পাঠদান করা প্রয়োজন। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে ঐ বিষয়ে কমপক্ষে শতকরা ৬০ ভাগ নম্বরকে পাস হিসাবে গণ্য করতে হবে। সকল বিষয়ে উত্তীর্ণ হলেও, ধর্ম শিক্ষায় ফেল হলে ওই শিক্ষার্থী ধর্ম শিক্ষায় ভালোভাবে জ্ঞান অর্জন করে পুনরায় পরীক্ষা দিয়ে পাস করলে উপরের শ্রেণিতে অধ্যায়ন করার যোগ্যতা অর্জন করবে।

এ বিষয়ে বিভিন্ন জনের মতামত নিয়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে কার্যকর করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় ফলপ্রসূ ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা হলে শিক্ষার্থীদের কায়দা , আমপারা ও পবিত্র কোরআন পড়ার জন্য মক্তব, বাসায় হুজুর রেখে পড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই। পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষক রোজার মাসে সহি ভাবে বিদ্যালয়ে কোরআন শরীফ শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন। এজন্য ধর্ম শিক্ষককে রমজান মাসে বিশেষ সম্মানজনক ভাতা দিতে হবে। এর মাধ্যমে জাতি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ হবে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অবহেলার কারণে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী মক্তব ও মাদ্রাসায় চলে যায়। এ প্রবণতা কমে যাবে।

যত্রতত্র বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশেপাশের গড়ে উঠা শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করা হোক। বেসরকারি ও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা বন্ধ করা দরকার। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করার জন্য শিক্ষক সংকটসহ সকল চ্যালেঞ্জ দূর করতে হবে।

সর্বোপরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জ্ঞান অর্জনমুখী পাঠদানের উপলব্ধি সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ের আলোচনা সভা, সর্বস্তরের মানুষের মাঝে আদর্শপাঠ, তথা জ্ঞান অর্জনমুখী পাঠ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন, শারীরিক ও মানসিকসহ মেধার বিকাশ এ বাস্তব ধারণা সকলের মাঝে জাগ্রত হোক। পাশাপাশি শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, বা কমে যাওয়ার চ্যালেঞ্জগুলো দূর করার আহ্বান জানাচ্ছি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়