মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৫

দেশে ইংরেজি শিখন-শেখানোর হাল হকিকত

মাছুম বিল্লাহ
দেশে ইংরেজি শিখন-শেখানোর হাল হকিকত

বর্তমান বিশ্বে সফলতার জন্য ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগ দক্ষতার বিকল্প নেই। নিজের ভাবনা ও বক্তব্য স্পষ্ট ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারা আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষায় এটি এখনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এখানে পরীক্ষাকেন্দ্রিক সবকিছু অথচ পরীক্ষায় এসব নেই, আছে শুধু মুখস্থ তথ্য লেখার পদ্ধতি। ।

শুধু বিবেচনা আর ভুল এড়িয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তারা পেয়ে যাচ্ছে গ্রেড। ফলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখানোর যে ১২ বছরের সরকারি প্রজেক্ট সেটি আসলে তেমন কোনো কাজে আসছে না। তারপরেও রাষ্ট্রকে সেটি এবং তার সাথে প্রায় তিন লাখ ইংরেজি শিক্ষককে (প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক) প্রতিপালন করতে হচ্ছে এবং হবে।

শিক্ষার্থীরা পাসও করছে কিন্তু নিজেদের ব্যবহারের জন্য যে ইংরেজি দরকার সেটি অর্জন করছে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কমিউনিকেট করছে, তবে সেটি হয় পরিবার থেকে না হয় আধুনিক সোশ্যাল মিডিয়া থেকে, না হয় প্রয়োজনের তাগিদে শিখে নিচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা বাধ্যতামূলক ইংরেজি শেখার পরেও কোন ধরনের কমিউকেট করতে পারছেনা, তারা বাস্তব জীবনে গিয়ে ইংরেজি শেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ফলে ইংরেজি শেখার জন্য ভর্তি হয় কোচিং সেন্টারে। সেন্টারগুলো যেন এই ভাষা শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে। তারা আসলে কি করছে? কিছু সিচুয়েশনাল ডায়ালগ শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছে এবং সেগুলো অবার বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরছে। আসলে ভাষা শেখানোর এটি কোন পদ্ধতি নয়।

কারণ যে সিচুয়েশনগুলো তারা শেখাচ্ছে সেগুলো সব জায়গায়ই যে একই হবে তা কিন্তু নয় । সিচুয়েশন পরিবর্তন হলে শিক্ষার্থীরা কিছু বলতে পারবেনা। কারণ নেই সেই শব্দ ভান্ডার , বাক্য গঠন এবং নতুন পরিস্থিতি ফেস করার জন্য ন্যাচারাল প্র্যাকটিস । সেটি অর্জন করতে হয় ইংরেজি পরিবেশে বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে এবং ঐ ভাষার দক্ষতা মনের অজান্তে সাব-কনশাসলি আয়ত্ত্বে চলে আসে। ফলে যে কোন পরিস্থিতি শিক্ষার্থীরা মোকাবিলা করতে পারে। আবার অনেকে কিছু ট্রান্সলেশনের বই বের করেছে।

অনেকে ভেবেছে এই বই ব্যবহার করলেই বোধ হয় ভাল একজন কমিউনিকেটর হওয়া যাবে, বিষয়টি তাও নয়। এ ধরনের ট্রান্সলেশন শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে সারাজীবন করেছে। এই ধরণের দু’চার দশটি বাক্য জীবনের প্রকৃত কমিউকেশনে কাজে লাগেনা। কথা বলার সময় বা লেখার সময় অনেক ধরনের সিচুয়েশন একত্রে ঘটে। আমাদের নিজ ভাষা থেকেই তা আমরা দেখতে পাই, ইংরেজি আমরা সেভাবে শেখার বা শেখানোর চেষ্টা করিনা।

ইংরেজি যেহেতু একটি বিষয় হিসেবে পড়ানো হচ্ছে ভাষা হিসেবে নয় তাই ইংরেজি শেখানোর দায়িত্ব বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ নিয়েছেন! তারা বাজারে প্রচলিত গ্রামার বইয়ের মতো আরও দুএকটি ট্রান্সলেশনের বই তৈরি করে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখানোর কাজে নেমে পড়েছেন। শিক্ষার্থীরা ক্লাস-ফাঁকি কিংবা গুরুত্ব দিয়ে বার বছরে যেহেতু ইংরেজি পড়েনি, ব্যক্তিজীবনে এসে, কর্মজীবনে এসে যখন দেখছে যে, বাস্তব জীবনে তাদের যা যা দরকার তা তারা ঐ বার বছরে তেমন একটা পায়নি। ঐ বইগুলো যদি তারা গুরুত্ব দিয়ে পড়তেন, শিক্ষকরা যেভাবে পড়াতেন আর পরীক্ষাও সেভাবে হতো তাহলে তো আর নতুন করে এটি পড়ার জন্য কোথাও সেভাবে যেতে হতো না।

আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের পাস করা অর্থাৎ পার করিয়ে দেয়ার একটি মাধ্যম। এটি কখনও শিক্ষার্থীদের ইংরেজি দক্ষতা অর্জিত হয়েছে কিনা সেটি দেখার অ্যাসেসমেন্ট নয়। নির্দিষ্ট কিছু চ্যাপ্টারের প্রশ্ন, নির্দিষ্ট কয়েকটি রিঅ্যারেন্জমেন্ট, কয়েকটি প্যাসেজ থেকে ইনফরমেশন ট্রান্সফার, টেবিল থেকে বাক্য তৈরি করা, নির্দিষ্ট কিছু রাইট ফর্ম অব ভারব, বইয়ের কয়েকটি চ্যাপ্টার থেকে কিছু প্রশ্নোত্তর তাও সারাজীবন শুধু উত্তর দিতে হয়, শিক্ষার্থীরা কোন প্রশ্ন তৈরি করতে পারেনা কারণ তাদের সে ধরনের অনুশীলন নেই, বহু নির্বাচনী ইত্যাদি কিছু আইটেমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি দক্ষতা পরীক্ষা করা হয়।

আর এই পদ্ধতিতে লিসেনিং ও স্পিকিং তো নেই-ই। রাইটিং-এ যেসব আইটেম পরীক্ষায় আসে সেগুলো বাজারের গাইড বা টেস্ট পেপারস খুলে কয়েকটি নামকরা স্কুল বা কলেজের প্রশ্ন বিগত দুই তিন বছরের বোর্ডের প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচারা করলেই শুধু পাস নয়, উচ্চতর গ্রেড নিশ্চিত। এখানে আরেকটি ঘটনা ঘটে, তা হচ্ছে একটি শ্রেণিতে বা পরীক্ষার হলে দু-চারজন যখন এগুলো পারে, বাকীরা তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে তারাও একই ধরনের গ্রেড পেয়ে যায়। আর বোর্ড পরীক্ষায় উদারভাবে খাতা মূল্যায়ন এবং ভুল-ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়ার কালচার তৈরি হয়েছে বহু আগে থেকেই। কাজেই প্রকৃত অ্যাসেসমেন্ট হচ্ছে না।

এতো গেল শুধুমাত্র লেখার ক্ষেত্রে, বাকী যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ স্কীল সেটি পরীক্ষায় না থাকলেও শিক্ষকরা করাতে পারেন, কিন্তু কাদের করাবেন, কিভাবে করাবেন? শিক্ষার্থীরা তো ক্লাসে নিয়মিত আসেনা। কারণ পাসের জন্য ক্লাস করার দরকার নেই, এমনকি ভাল গ্রেড পাওয়ার জন্যও ক্লাস করার দরকার নেই। এখানে আমাদের কাজ করা দরকার। কিন্তু করবেটা কে?

উপরোক্ত আলোচনার বাইরে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি দক্ষতা টেস্ট করতে গেলে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের মানহানি, চাকরি নিয়ে টানাটানি, বোর্ড কর্তৃপক্ষের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার, রাস্তাঘাটে গাড়ীঘোড়া ভাঙচুর, হরতাল, অবরোধ কারণ প্রশ্ন কঠিন হয়েছে।

তার মানে হচ্ছে কেউ শিখতে চাইনা, শিখবো না কিন্তু গ্রেড পেতেই হবে। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক শিক্ষক আছেন তারা বাস্তব অবস্থা চিন্তা না করে হঠাৎ সব দোষ চাপান সরকারের উপর। সরকার এখানে কি করবে? হঠাৎ প্রশ্ন কিংবা পদ্ধতি পাল্টালে, মানুষ তো রাস্তাঘাটে চলতে পারবেনা। সবাই দেখা যাবে না শেখানোর দলে,সবাই সহানুভূতি পাওয়ার দলে, কেই প্রকৃত শেখার দলে নেই। তাই, সরকার কি করবে?আমরা যদি বুঝি ইংরেজি আমাদের শিক্ষার্থীদের শিখতে হবে , শেখাতে হবে তাহলে নিজেদেরই মোটিভেটেড হতে হবে, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মোটিভেটেড করতে হবে। সরকারের দিক থেকে যেটি করতে হবে ধীরে ধীরে, একটি দুটি করে প্রশ্ন পাল্টাতে হবে যেগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অরজিনালিটি টেস্ট করা যায়। অনেকেই বলেন শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে! ঢেলে সাজাতে গেলে শিক্ষার্থী অভিভাবক, সমালোচক , রাজনীতিবিদ সবাই মিলে যারা ঢেলে সাজাতে চান, তাদেরকে সাজাবেন! দেশের বাস্তবতা এখন এটি!

আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রকাশকদের সহজতর থেকে সহজতম ইংরেজি নোট ও গাইড বের করা। সরকারি এবং ইংরেজি শিক্ষক কমিউনিটির দুর্বলতার সুযোগে এসব প্রকাশকরা প্রতিটি ওয়ার্ডের বাংলায় লেখা উচ্চারণ ও লাইনের বাংলা অর্থ দিয়ে বাজারে বই ছাড়ছেন। শিক্ষার্থীরা বুঝতেই পারেনা যে তারা ইংরেজি শিখছে না বাংলা শিখছে। বিষয়টি ইংরেজি শিক্ষকদের প্রথমে খেয়াল করা দরকার ছিল। প্রকাশকরা বলেন বাংলা লেখা না থাকলে ইংরেজি শিক্ষকরা সেই বই নিজেরা পড়েন না এবং শিক্ষার্থীদেরও কিনতে বলেন না। অথচ এভাবে বাংলায় ইংরেজি পড়লে এক দিকে যেমন তাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যাবিলিটি এবং ভাষাগত দক্ষতা দুটোই মারাত্মভাবে দুর্বল হয়ে যায়।

আর ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি চলে যায় বনবাসে। কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখানোর জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে ল্যাংগুয়েজ ল্যাব প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন। মনে হয়, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ছাড়া কি অন্য কোন বিষয় আর নেই যে, সব ইনভেস্টমেন্ট ইংরেজি শেখার জন্যই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকারকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে ল্যাব বানাতে হবে। তৃতীয়ত, এ ধরনের বুদ্ধি কি সরকারে যারা আছেন তাদের নেই? সর্বশেষ হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব আছে কিন্তু সেগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে, ধুলোয় ভরে আছে। কোটি কোটি ডলার লোন করে ইংরেজি ল্যাব বানালে ঐ একই অবস্থা হবে।

ইংরেজি শেখানোর জন্য শিক্ষকদের ইংরেজি প্রশিক্ষণের কথা আমরা অহরহ শুনছি, প্রশিক্ষণ হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কারণ প্রশিক্ষণ, বাস্তবতা, শ্রেণিকক্ষ, মূল্যায়ন এগুলোর প্রতিটির মধ্যে রয়েছে বিশাল গ্যাপ। সেই গ্যাপ নিয়ে কেউ কথা বলছিনা, বুঝার চেষ্টা করছিনা। ইদানিং দেখা যাচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষকদের ইংরেজি পড়ানোর জন্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা প্রশিক্ষণ করানো হচ্ছে , তার মানে হচ্ছে উপরের যেসব গ্যাপের কথা বললাম, সেই গ্যাপ আরও বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টি এমন, নিউ ইয়র্ক কিংবা লন্ডন সিটির কিছু অধিবাসীদের ডাকা হচ্ছে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও কিংবা ঝালকাঠি শহরের সমস্যাবলি দূর করতে এবং উন্নতমানের শহর তৈরি করতে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতে।

নিউইয়র্ক সিটি বা লন্ডন সিটির ব্যবস্থাপনা, নাগরিক সুবিধা, অর্থনৈতিক অবস্থা, সমস্যাবলী, সমাধানের পথ, ম্যানেজমেন্ট কোনটির সাথেই ঠাকুরগাঁও কিংবা ঝালকাঠির মিল হবেনা। ঢাকার সাথেই হয়না , ঠাকুরগাঁও তো দূরের কথা! তাদের দ্বারা বাংলাদেশের ছোট শহরের বিষয়ে জানা এবং সমাধান দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু অনেকে এটি না ভেবে অর্থ খরচ করেই চলেছেন আর ইংরেজি শেখানোর ক্ষেত্রে ফারাক বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হচ্ছে!

আমাদের প্রাথমিক থেকে ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত দৈনন্দিন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় স্পিকিং, ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং, স্পিচ ও ক্লাস প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা যদি করা যায় তাহলে ধীরে ধীরে অবস্থার কিছুটা হলেও পরিবর্তন আশা করা যায়। প্রচলিত পদ্ধতিতে যা চলছে তার কোনেটিই যে কার্যকরী নয় তার প্রমাণ আমরা পদে পদে পাচ্ছি।

এগুলো করার জন্য ইংরেজি শিক্ষকদের নিজেদের দক্ষ করে তুলতে হবে, সেটি বিদেশি বা কোন সংস্থা প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের দক্ষ বানিয়ে ফেলবে তারপর আমরা ইংরেজি সেভাবে পড়াবো, সেই ধারণা থেকে বের হতে হবে। সরকারকে ধীরে ধীরে ইংরেজির অ্যাসেসমেন্ট পরিবর্তন করতে হবে, হঠাৎ করতে গেলে আন্দোলন হবে যা সামাল দেয়ার অবস্থা থাকবে না। আমরা যদি আন্তরিকভাবে চাই যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা ভাল ইংরেজি জেনে নিজেদের, সমাজের ও দেশের উন্নয়নে তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখবে, তাহলে তারা যাতে ইংরেজি শিখে আসলেই কাজে লাগাতে পারে সেই ব্যবস্থাটি করতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়