মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৪৭

কারিকুলাম পরিবর্তনের আগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিত্তি শক্ত করা প্রয়োজন

মাছুম বিল্লাহ
কারিকুলাম পরিবর্তনের আগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিত্তি শক্ত করা প্রয়োজন

বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক। তাই শিক্ষাকে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় যার জন্য প্রয়োজন হয় নিয়মিত কারিকুলাম পরিবর্তন। কিন্তু আমাদের দেশে বিষয়টি অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকঢোল পিটিয়ে বড় আয়োজনে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের মুখস্থ নির্ভরতা কমিয়ে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এই কারিকুলাম।

বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে হাতেকলমে শেখানো হবে অনেক কিছু। কিন্তু অভিভাবকরা ওই কারিকুলাম স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করতে পারেননি। তাদের অভিযোগ ছিল, এমন কারিকুলামের কারণে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং সেটি আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করেছি যে, শিক্ষার্থীদের কি মহাসর্বনাশ ঘটানো হয়েছিল তাই সেটি বাতিলের জন্য আন্দোলন হয়।

এরপর ছাত্রজনতার অভুত্থানে সরকার পতন হলে বন্ধ হয়ে যায় সেই কারিকুলাম, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবর্তন করা হয় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের সেই আগের শিক্ষা কারিকুলাম। এক যুগের বেশি সময় আগের প্রণয়ন করা এ কারিকুলামও জায়গায় জায়গায় পরিবর্তন করে কিছুট খাপছাড়া অবস্থায় শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।

সরকার ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মাধ্যমিকে পরিমার্জন করে নতুন কারিকুলাম চালু করতে যাচ্ছে বলে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। প্রথম বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে তা চালু করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন বা পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম চালু করা হবে। তবে, নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের বিষয়টি একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলেও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

দেশে রাজনৈতিক সরকার না থাকায় কারিকুলামে তৈরিতে কোন প্রক্রিয়া অনুসরন করা হবে বা কোন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হবে তা নিয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক মো. সাহতার উদ্দিন বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারিকুলাম যাচাইবাছাই করে নতুন কারিকুলাম তৈরি করা হবে। নতুন কারিকুলামে পাঠদান শুরু হবে ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। নতুন কারিকুলাম তৈরি নিয়ে নানান অ্যাসেসমেন্ট চলমান রয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসে কারিকুলাম বিষয়ে একটি কর্মশালা হওয়ার কথা ছিল, সেটি পিছিয়ে জুলাইয়ে করার কথা শোনা যাচিছলো কিন্তু হলো কিনা আমরা নিশ্চিত না।

এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী বছরে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই এ কারিকুলামের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। সরকারের প্রত্যাশা ও নির্দেশনার ওপর নির্ভর করবে শিক্ষা কারিকুলামের অনেক কিছুই। আবার এটিও শোনা যাচেছ যে, নতুন কারিকুলামে অভিজ্ঞতালব্ধ, জ্ঞাননির্ভর ও বাস্তবসম্মত পাঠদান করা হবে ছাত্রছাত্রীদের। তবে ঠিক কী পদ্ধতিতে পাঠদান বা মূল্যায়ন করা হবে সে ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি এখনো। নতুন কারিকুলামে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের কারিকুলাম ও ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের কারিকুলামের নানা বিষয়ও থাকতে পারে। তবে ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দে চালু হওয়া করিকুলামের চরিত্র নির্ভর করবে সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত রাজনৈতিক সরকারের প্রত্যাশার উপর।

কারিকুলাম নিয়ে নানা আলোচনা আর কর্মশালা শুরু হলেও অন্তবর্তী সরকারের আমলে এই কারিকুলাম করা সম্ভব নয়, তাছাড়া এই সরকারের এটি কাজও নয়। ২০২৪-এ পূর্ববর্তী সরকারের পতন পর্যন্ত প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলছিলো। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বছর চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শ্রেণিতেই তা চালুর কথা ছিল, কিন্তু জুলাই অভুত্থানের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম বাতিল হয়ে যায়। তার পরিবর্তে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম পুনবর্হাল করা হয়েছে।

এনসিটিব জানায় যে, আমরা যদি নতুন স্বপ্ন দেখি, যদি নতুন পরিকল্পনা করি, সেখানে প্রযুক্তির বিষয় থাকবে, অন্তভূর্ক্তির বিষয় থাকবে, সেখানে দায়, দরদ, ইনসাফ যে শব্দগুলোই ব্যবহার করতে চান না কেন, নিশ্চয়ই বর্তমানের যে শিক্ষাক্রম তার থেকে মুক্তচিনাৎ করতে হবে। সে জন্য নিজেদের ও অংশীজনদের মধ্যে আলোচনা এবং জাতীয় ঐক্যমতের বোধ হয় একটা প্রয়োজন রয়েছে। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষাক্রম বিশেষ পরিস্থিতিতে পনুবর্হাল করা হয়েছে যা ২০২৬-ও তা থাকবে।

তবে নিজের মেয়াদকালে মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রমের ভিত করে যেতে পারবেন বলে মনে করেন বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা। ২০২৭খ্রিষ্টাব্দে যাতে ষষ্ঠ শ্রেণি নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসে, সে বিষয়ে কাজ করা হচেছ। তারা মনে করছেন একসঙ্গে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি র্পর্যন্ত শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা সুচিন্তিত নয়। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় যাবেন।

কারিকুলামের নামে পূর্ববর্তী সরকারের মতো যাতে মহাযজ্ঞে পরিণত না হয়। সমস্ত দেশকে উল্টে দেয়ার মহা পরিকল্পনা! সমস্ত শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বন্ধ রেখে, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অন্ধকারে রেখে , ধাঁধাঁর মধ্যে ফেলে দিয়ে ক্লাসরুম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া বাদ দিয়ে, বই পুস্তকবিহীন মাসের পর মাস কিংকর্তব্যবিমূঢ় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের কসরতে করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আর নীতিনির্ধারকেরা সেটিকে বলে বেড়াচিছলেন যে, এটিই আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা!

শিক্ষার্থীরা শুধু বই পড়বে না, এভাবেই শিখবে। আসলে সময়ের দু’ বছরের অধিকাল শিক্ষার্থীরা বইয়ের ধারে কাছেও যাননি, শিক্ষকরা ছিলেন অন্ধকারে।এর পেছনে যে দুটি বড় উদ্দেশ্য ছিল সেটি দুটিকে ঢাকা দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই প্রচারণার জন্য আবার কিছু লোকও ঠিক করা হয়েছিল মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। ঐ কারিকুলামের একটি অর্থিক লাভ, দ্বিতীয়টি, ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে যুগোপযোগী কোন শিক্ষা না পায়, বিদেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষাবিদ, ডাক্তার নিয়ে আসতে হয় সেই ব্যবস্থা ছিল। এ ধরনের কিছু না করার জন্য বর্তমান ও আগত সরকারকে আগে থেকেই অনুরোধ করছি।

আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো পুরো কারিকুলাম পরিবর্তন করলে আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষক সেটির সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো অবস্থায় নেই। তারপর যে মূল্যায়ন পদ্ধতি আমরা অনুসরণ করে আসছি তা কেবল শিক্ষার্থী পাস করানোর, তারা প্রকৃতঅর্থে কি কি যোগ্যতা অর্জন করলেন সেই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আমরা নেই। শিক্ষার্থীরা করোনা, পূর্ববর্তী কারিকুলাম পরিবর্তনজনিত কারণে এবং সর্বশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর পুরো শিক্ষাব্যবস্থা একটি হ-য-র-ব-ল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচেছ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সম্পর্ক এক নাজুক অবস্থায় আছে।

পুরো দেশের চিত্র হচেছ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের পর থেকে ঠিকমতো শ্রেণিকক্ষে আসছেনা, যারা আসছেন শিক্ষকরা তাদের পড়াশুনায় বসাতে পারছেন না। আর যারা ক্লাসে আসেন, কাল তারা আসেন না। শিক্ষকরা কোনোভাবে তাদের পড়াশুনায় মনোনিবেশ করাতে পারছেন না। শিক্ষকরা নিয়মানুযায়ী তাদের পড়া আদায়ের কথা বললে সাথে সাথে তাদের উপর নেমে আসে বিভিন্ন অভিযোগ, লাঞ্জনা এমনকি শারীরিক নির্যাতন! অনেক শিক্ষক এখনও নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেতে পারেন নি।এমতাবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এক মহাসংকটের মধ্যে দিয়ে যাচেছ।

দেশের শিক্ষার প্রকৃত গবেষক থাকলে এসব বিষয়ে ঘন ঘন ষ্টাডি ও গবেষণা হতো, যারা এগুলো দেখছেন না বা বুঝতে পারছেন না তারা সেসব স্টাডি থেকে অনেক কিছু পেতেন। কারিকুলামের সাথে শিক্ষার যেসব বাকী বিষয়গুলো জড়িত সেগুলোরও পরিবর্তন প্রয়োজন যা একবারে করা সম্ভবও নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো মাধ্যমিক ও উচচ মাধ্যমিক শিক্ষার পুরো ব্যবস্থাপনা এখনও প্রশ্নের মুখে। সেটি সুরাহা না করে কারিকুলাম পরিবর্তনের চিন্তা পুরো বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নয় কারন বাস্তবায়ন করবেন কারা এবং কিভাবে করবেন?

এখন সবচেয়ে বড় কাজ হচেছ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে আসছেন না, শিক্ষকদের সাথে সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি, অভিভাবকদের ভূমিকাও সেভাবে পজিটিভ নয়। এমতাবস্থায় সর্বপ্রথম প্রয়োজন এই অবস্থার উন্নতি ঘটানো। যাদের জন্য কারিকুলাম পরিবর্তন করা হবে তারাই যদি নাজুক অবস্থার মধ্যে থাকেন তাহলে কিসের কারিকুলাম পরিবর্তন আর কিভাবে সেটি করা হবে? এতে না শিক্ষক না শিক্ষার্থী মনোনিবেশ করতে পারবেন। তাহলে বিষয়টির পরিবর্তনে কারা কাজ করছেন? অভিভাবকদের আমরা এখনও শিক্ষা কার্যক্রমে ফলপ্রসূভাবে অংশগ্রহণ করাতে পারছিনা। এটিও একটি বিরাট বিষয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়