প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৫, ০৯:৪৭
স্কুল কলেজ থেকেই শুরু হোক দক্ষতা উন্নয়নের যাত্রা

বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা আর কেবল পুঁথিগত জ্ঞান অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, নেতৃত্ব, যোগাযোগ, সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। এ সকল গুণাবলি অর্জন করতে হলে তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট’ বা দক্ষতা উন্নয়নের দিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, পাবলিক, প্রাইভেট এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রতিবছর লাখো শিক্ষার্থী পাস করে বের হলেও বড় একটি অংশ চাকরির বাজারে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়। চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই অভিযোগ করে থাকে-প্রার্থীদের ডিগ্রি থাকলেও বাস্তব দক্ষতা ও কর্মদক্ষতা নেই। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেÑচাকরি নেই। এই দ্বিমুখী সঙ্কট আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ফাঁক-ফোকরের বহিঃপ্রকাশ।
বর্তমানে চাকরির বিজ্ঞপ্তিগুলোতে প্রায়শই দেখা যায়, ‘দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রার্থী অগ্রাধিকার পাবে।’ কিন্তু বাস্তবতা হলোÑআমাদের শিক্ষার্থীরা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের পর্যাপ্ত সুযোগ ও অনুপ্রেরণা পায় না কিংবা নিতে চায় না। যার ফলে পাস করার পর তারা নতুন করে স্কিল ডেভেলপ করতে গিয়ে সময় হারায় এবং প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।
স্কুল ও কলেজে থাকাকালীন সময়টাই একজন শিক্ষার্থীর জন্য নিজের দক্ষতা গড়ার উপযুক্ত সময়। সহ-শিক্ষা কার্যক্রম যেমন উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্কাউট, বিএনসিসি, রেডক্রিসেন্ট, আইটি ক্লাব, প্রোগ্রামিং ক্লাব ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ শিক্ষার্থীর সামাজিক, মানসিক ও নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে তোলে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী একদিকে যেমন নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে, তেমনি ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
বলা বাহুল্য, এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শিক্ষার্থীর একাডেমিক রেজাল্টের ক্ষতি না করে বরং সহায়ক হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিক্ষার্থী সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে সক্রিয় থাকে, তারা সাধারণত পড়াশোনায়ও সফলতা অর্জন করে। কারণ তাদের মধ্যে সময় ব্যবস্থাপনা, লক্ষ্য নির্ধারণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো প্রয়োজনীয় দক্ষতা গড়ে উঠে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে এখনও অনেক অভিভাবক এবং শিক্ষার্থী মনে করেন, এসব সহ-শিক্ষা কার্যক্রম শুধুই সময়ের অপচয় এবং তা একাডেমিক ফলাফলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্তমান যুগের চাকরিদাতারা একাডেমিক রেজাল্টের পাশাপাশি ব্যক্তিগত দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দেন। বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞপ্তিতেও স্পষ্টভাবে বলা থাকে ‘দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রার্থী অগ্রাধিকার পাবে।’ এর ফলে সদ্য পাস করা অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে এবং অনেক সময় অতি সামান্য বেতনে চাকরি করতে বাধ্য হয়, যা একটি মাস্টার্স ডিগ্রিধারীর জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক।
বর্তমানে বাংলাদেশে তরুণদের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটির বেশি। এই বিশাল যুবসমাজ আমাদের সম্ভাবনার বড় শক্তি। কিন্তু তাদের মধ্যে যদি কর্মদক্ষতা, প্রযুক্তিজ্ঞান, কমিউনিকেশন স্কিল, উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস না থাকে, তবে তারা জাতীয় সম্পদ না হয়ে সমাজের বোঝায় পরিণত হবে। আগামী বিশ্বে যেসকল দক্ষতাগুলো আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে এগিয়ে রাখবে :
* কম্পিউটার ব্যবহারে দক্ষতা (MS Word, Excel, PowerPoint)
* গ্রাফিক ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং, ওয়েব ডিজাইন
* প্রোগ্রামিং ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট (C, Python, Java ইত্যাদি)
* ডিজিটাল মার্কেটিং ও সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট
* যোগাযোগ দক্ষতা (Communication skill), পাবলিক স্পিকিং
* সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও দলবদ্ধভাবে কাজ করার দক্ষতা
* উদ্যোক্তা হওয়ার মনোভাব ও ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা
* ভাষাগত দক্ষতা (বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সাবলীলতা)
* টাইম ম্যানেজমেন্ট ও আত্মনিয়ন্ত্রণ
* মৌলিক আইটি জ্ঞান ও ইন্টারনেট ব্যবহারে সক্ষমতা
সুতরাং প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে যেমন ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, ই-কমার্স ইত্যাদি স্কিল সম্পন্ন তরুণদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এসব স্কিল অর্জন করে শিক্ষার্থীরা শুধু চাকরি পাবে না, নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারবে।
আমার মতে, সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কিল ডেভেলপমেন্ট কার্যক্রমকে বাধ্যতামূলক করা। মূলত এটি স্কুল পর্যায় থেকেই শুরু করা উচিত। শিক্ষাক্রমে বাস্তবমুখী শিক্ষার অংশ হিসেবে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ, সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি, প্রজেক্ট ভিত্তিক শেখানো ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। একই সঙ্গে শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে যেন তারা শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী দক্ষতা গড়ে তুলতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায়, আজকের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের বর্তমান প্রস্তুতির উপর। আর সেই প্রস্তুতি কেবল এচঅ ৫.০০ নয়, বরং বাস্তবজীবন দক্ষতায় সজ্জিত হওয়াও অত্যন্ত জরুরি। তাই শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজ ও সরকারÑসকলের সম্মিলিত উদ্যোগে আমাদের দেশের তরুণ সমাজকে গড়ে তুলতে হবে দক্ষ, কর্মমুখী ও আত্মনির্ভর করে। সুতরাং ‘শুধু শিক্ষিত হলে হবে না, হতে হবে দক্ষ। শুধুমাত্র পাস করলে হবে না, থাকতে হবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো প্রস্তুতিও।’
মো. ফয়সাল আহম্মেদ ফরাজী : সহকারী অধ্যাপক, আইসিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, চাঁদপুর।