প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৫, ২৩:৩১
মুক্তিযুদ্ধের জ্বলন্ত মশাল মোস্তফা মহসিন মন্টু
----সারোয়ার ওয়াদুদ চৌধুরী---

মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় বীর, গণফোরাম সভাপতি, সাবেক সাংসদ সদ্য প্রয়াত মোস্তফা মহসিন মন্টু ১৯৪৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মীর জাহান ও মাতার নাম রাহেলা খাতুন।
|আরো খবর
কেরানীগঞ্জ উপজেলা ঢাকার নিকটে বুড়িগঙ্গার পাড়ে অবস্থিত, এর উত্তর ও পূর্বে বুড়িগঙ্গা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী। তিন দিকে নদী বেষ্টিত বিধায় সিরাজুল আলম খানের পরিকল্পনায় ও মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বে বৃহত্তর ঢাকা জেলার মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার গোপন ঘাঁটি কালিন্দি ইউনিয়নের নেকরোজবাগসহ বিভিন্ন স্থানে গোপন আস্তানা গড়ে তুলে প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
মোস্তফা মোহসীন মন্টু ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেন।
১৯৭০-এর নির্বাচনের পর বাঙালিদের এক প্রতিবাদী মিছিলে বিহারী হামলা চালালে প্রতিরোধের সময় মারা যায় এক পাকিস্তানী সেনা। এ অপরাধে মোস্তফা মোহসীন মন্টু সহ আরো অনেককে বন্দী করা হয়। মন্টু ভাইকে দেয়া হয় আটাশ বছরের কারাদণ্ড।
মাতৃভূমিকে ভক্তি করে ১৯৭১ সালে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দিতে জেলের তালা ভেঙে ১ মার্চ বেরিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলে যান কেরানীগঞ্জে। মন্টু ভাই, নূর-ই-আলম, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আশ্রিত মানুষদের পাহারায় ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মন্টু ভাইয়ের নেতৃত্বে কেরানীগঞ্জ থানা দখল করে সকল অস্ত্র হস্তগত করে প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিন এপ্রিল কেরানীগঞ্জে পাকবাহিনীর হামলায় ৩ থেকে ৪ হাজার লোক মারা যায় এবং কেরানীগঞ্জে পাকবাহিনীর বিমান হামলা ও বেপরোয়া গণহত্যার কারণে বেশিদিন প্রতিরোধ যুদ্ধ চালানো সম্ভব হয়নি। ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শেষে সম্মুখ সমরে যেমন অংশ নিয়েছেন, সংগঠিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধকেও।
২৬ নভেম্বরে আবারো কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দায় আক্রমণ করে পাকিস্তানী বাহিনী। হয় দুই দিনের তুমল যুদ্ধ। ষোলই ডিসেম্বর বিজয়ের দিনও মন্টু ভাই কয়েক দফা যুদ্ধ করেন হানাদারদের সঙ্গে। জীবন বাজি রেখে নয় মাসের মরণপণ যুদ্ধে অস্ত্র হাতে এই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন করেছেন বাংলাদেশ।
পরবর্তীতে তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে মাফিয়া-চাকর লীগের ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যোগ দেন। ২০০৯ সালে তিনি গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
মোস্তফা মহসীন মন্টু, যাঁর নিজের পরিচয় ছিলো ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ পত্রিকার শোকপ্রকাশ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুতাপ আর সহযোদ্ধাদের চোখের জলে স্পষ্ট—এই প্রস্থান শুধু একটি মানুষের মৃত্যু নয়, একাত্তরের স্বপ্নকে জ্বালিয়ে রাখার অগ্নিশিখার দীপ নিভে যাওয়া।
ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা কাঁপিয়ে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে তাঁর বজ্রকণ্ঠ শুনেছিলো সৈনিকেরা—এখনও সে ধ্বনি শুনলে কাঁপে টিএসসির শিলামাটির সিঁড়ি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আলো ফুটতেই কেরানীগঞ্জকে দুর্গ করে বৃহত্তর ঢাকা জেলা গেরিলা বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব নিলেন মন্টু। বুড়িগঙ্গার কালো জলে নৌকা চালিয়ে দুই হাতে দুই মেশিনগানের ব্রাশফায়ার—লোককথা নয়, অগণিত প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচিত্র। ২৫ মার্চের বিভীষিকাময় রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে সর্বশেষ দেখা করে সিরাজুল আলম খান ও মোস্তফা মহসিন মন্টু শেষ নির্দেশ নিয়েছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন, " আপনি ৩২ নম্বরে থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করবেন, আপনি আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবেন কেন? আপনি বাঙালি জাতির সূর্য! আপনাকে কেউ নেভাতে পারবে না, আপনি পালিয়েও যাবেন না। আমরা চলে যাচ্ছি আন্ডারগ্রাউন্ডে স্বাধীনতা যুদ্ধে। আপনার নির্দেশ মতো দেশ স্বাধীন করেই ফিরবো ইনশাআল্লাহ।”
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামকে নিরাপদে শহর ছাড়ানোর দায় তাঁর কাঁধেই।
পাকিস্তানি হানাদাররা ‘মন্টু কোন্ হ্যায়?’ খুঁজেছে ঘাটে ঘাটে, কিন্তু জিঞ্জিরার রক্তাক্ত ঘাটেও কেউ তাঁর গ্রামের পথ দেখায়নি—এমন ঋণ কি ইতিহাস শোধ করতে পারে? যুদ্ধের শুরুতেই তিনি আশ্রিত লক্ষ মানুষের জন্যে কেরানীগঞ্জে ৩০০-এর বেশি লঙ্গরখানা, যুবকদের জন্য ২০-এর অধিক প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলেন—‘খেয়ে নাও, তার পরে লড়ো’ ছিলো তাঁর সামরিক-মানবিক দ্বৈরথের মন্ত্র।
মন্টু চাইলে কেরানীগঞ্জের অর্ধেকের মালিক হতে পারতেন। স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নামের কিছু কুলাঙ্গার ঢাকা শহরের অনেক সম্পদ দখল করেছে, মন্টু থেকেছেন মাটির ঘ্রাণে; সে ঘ্রাণের সঙ্গে ছিল বঙ্গবন্ধুভক্তি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন আপোষহীন। জীবদ্দশায় ‘এক টাকার অনিয়মও’ তাঁর নামে প্রমাণ করতে পারেনি কেউ, আজও পারবে না—এটাই তাঁর মৌন গৌরব ।
শেষ বয়সে ছিলো অভিমান—মুক্তিযুদ্ধের সেই দুরন্ত কমান্ডারকে রাষ্ট্রযন্ত্র কতখানি মনে রেখেছে? অভিমান বুকের ভেতর লুকিয়ে তিনি বরং তরুণদের বলতেন, ‘আদর্শের জন্যই বাঁচো।’
এখন, যখন বর্ষার আকাশে নক্ষত্রেরা লুকিয়ে পড়ে, বুড়িগঙ্গার ঢেউয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গেরিলা নৌকার ছাপ, তখনও মন্টু ভাইয়ের নামে বাতাসে ভেসে আসে লাল সবুজের পতাকার ভেজা গন্ধ। তিনি নেই, তবু তাঁর লঙ্গরখানার ধোঁয়া আজও আমাদের বিবেককে জাগ্রত করে, তাঁর মেশিনগানের গর্জন ইতিহাস হয়ে থাকবে।
মোস্তফা মহসীন মন্টু—এই নাম লিখতে গিয়ে কলম থমকে যায়, স্মৃতি তুমি বেদনা। মন্টু ভাই আপনার অভিমান ভুলে না-যাওয়া পর্যন্ত আমরা অপরাধীই থেকে যাবো। আমাদের লড়াইয়ে থাকুক আপনার অদম্য সাহসের শিখা।
সারোয়ার ওয়াদুদ চৌধুরী :
লেখক ও গবেষক,।