রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২৫, ১৫:২৮

কাদা আর কচুরিপানায় মিশে যাওয়া মন্ত্রিত্বের অহংকার!

এক সময়ের প্রতাপশালী মন্ত্রীর পলায়ন: ক্ষমতার চূড়া থেকে কর্দমাক্ত পুকুরে!

প্রতিবেদন: মো. জাকির হোসেন
কাদা আর কচুরিপানায় মিশে যাওয়া মন্ত্রিত্বের অহংকার!
ছবি :শ ম রেজাউল করিম(সংগৃহীত)

এক সময়ের মন্ত্রিসভার দাপুটে কণ্ঠস্বর, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মিডিয়া-বান্ধব রাজনীতিক—শ ম রেজাউল করিম। গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং পরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আলোচিত হলেও, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক ভাঙনে তাঁর জীবনের রূপরেখা বদলে যায়। আজ তিনি এক পালাতক, যার জীবন রক্ষার উপায় ছিল কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে থাকা। এই ‘মৃত্যু থেকে ফিরে আসা’র কাহিনি এখন কেবল একটি ব্যক্তিগত গল্প নয়, বরং একটি শাসনব্যবস্থার অন্তর্জ্বালা।


সীমান্ত পাড়ি: এক মন্ত্রীর ভয়াল বাস্তবতা

২০২৫ সালের জুনে লন্ডনে ফজলুল বারীর ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শ ম রেজাউল করিম নিজের কণ্ঠেই শোনান পালানোর করুণ গল্প। তিনি বলেন, "আমি যদি দেশ না ছাড়তাম, বেঁচে থাকতাম না।" নিজেকে বাঁচাতে তিনি কয়েক ঘণ্টা এক পুকুরের নিচে কচুরিপানার আড়ালে নিঃশ্বাস চেপে লুকিয়ে ছিলেন। সেনা টহল ও হেলিকপ্টারের শব্দে প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও, ভাগ্যক্রমে সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি।

ক্ষমতার উত্থান ও পতন

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রেজাউল করিম ছিলেন ক্ষমতাধর মন্ত্রী ও প্রেস-ফ্রেন্ডলি ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে জমি দখল, দুর্নীতি, প্রকল্প বাণিজ্য, পছন্দের লোক নিয়োগসহ নানা অভিযোগ ছিল বহুল আলোচিত। দুদকের একাধিক তদন্তে তার নাম ঘুরেফিরে এসেছে বারবার।

২০২৪ সালের নির্বাচনের পর জনঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের প্রেক্ষাপটে নতুন প্রশাসন তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি আদালত তাঁর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান এবং পরে সীমান্ত পাড়ি দেন।

কেন পালালেন? ভয়, অনুশোচনা না বিচার এড়ানো?

সাবেক একজন মন্ত্রীর এভাবে পালানো কেবল ভয় বা রাজনৈতিক বিদ্বেষ নয়—বরং এটি তাঁর অতীতের কর্মকাণ্ডের পরিণতি। এক সময় যিনি বলতেন “রাষ্ট্রদ্রোহীদের শাস্তি নিশ্চিত করব,” সেই তিনিই আজ রাষ্ট্রীয় আইনের চোখে অভিযুক্ত। “রাষ্ট্রের শক্তি একসময় আমার ছিল, আজ সেই রাষ্ট্রের হাতেই আমি অপরাধী”— এই বক্তব্যে ফুটে ওঠে আত্মোপলব্ধি ও লুকানো অনুশোচনা।

হৃদয়বিদারক সাক্ষাৎকারের ঝলক

সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “পুকুরের নিচে আমি কাদার ভেতর ছিলাম। হেলিকপ্টারের আওয়াজ, সেনা জিপের গর্জন—আমি নিঃশ্বাসও ঠিকমতো নিতে পারছিলাম না। মনে হয়েছিল এখানেই হয়তো শেষ।” তার মেয়ের কথাও তুলে ধরেন তিনি—“বাবা, পালিয়ে যাও, না হলে ওরা মেরে ফেলবে।” এই কাহিনি নিছক নাটক নয়, বরং এক প্রাক্তন ক্ষমতাবানের মানবিক বিপর্যয়।

তদন্ত, নিষেধাজ্ঞা ও বিচারিক প্রক্রিয়া

২০২৪ সালের শেষ দিকে তার ব্যাংক হিসাব, জমি, প্রজেক্ট সংক্রান্ত আয়-ব্যয়, বিদেশ যাত্রা—সবই খতিয়ে দেখা শুরু করে প্রশাসন। ট্রাভেল ব্যান জারির পর থেকেই তার অবস্থান অজ্ঞাত ছিল। শোনা যায়, এর মাঝে তিনি নিজেকে ‘উধাও’ করে দেন—কোনো খাস কামরায় নয়, বরং পুকুরের কাদাজলে।

কলকাতা হয়ে লন্ডন: আন্তর্জাতিক হিসাব-নিকাশ

সীমান্ত পার হয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় আশ্রয় নেন। সেখানে আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ কয়েকজন প্রবাসী নেতার সহায়তায় কিছুদিন থাকেন এবং পরে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। বর্তমানে তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছে ‘পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম’ আবেদন করেছেন।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ

বিএনপি নেতৃবৃন্দ এই ঘটনাকে আওয়ামী লীগের ভেতরে দুর্নীতি, ভয়ের সংস্কৃতি ও ভ্রষ্ট নীতির প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান মন্তব্য করেন— "এটি কেবল একজনের গল্প নয়; এটি ক্ষমতা নির্ভর রাজনীতির করুণ পতনের দলিল।"

আমরা এখান থেকে কী শিক্ষা পাই?

শ ম রেজাউল করিমের পালানোর এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ন্যায় ও জনকল্যাণের রাজনীতি চিরস্থায়ী। আজ যিনি মন্ত্রী, কাল তিনিই পলাতক। রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপব্যবহার করে যিনি অন্যকে দমন করতেন, সেই একই যন্ত্র একদিন তাকেই গিলে ফেলতে উদ্যত হয়।

এই ঘটনাই প্রমাণ করে—জনগণই প্রকৃত মালিক, আর রাজনীতির প্রধান শর্ত জবাবদিহিতা। দুর্নীতি, লোভ, ক্ষমতার অহংকার সবকিছুরই পরিণতি আছে। যারা ভুলে যান, তাদের জন্য ভবিষ্যৎ কখনো মমতাময় হয় না।

সর্বোপরি, এটি আমাদের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের জন্য একটি বার্তা—ক্ষমতার পেছনে নয়, সেবা ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ান। অন্যথায় কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে জীবন রক্ষা করতে হতে পারে আপনাকেও।

শ ম রেজাউল করিমের করুণ বিদায় একধরনের প্রতীক—সেই প্রতীক, যা আমাদের রাজনীতির আত্মসমালোচনা করতে শেখায়। রাষ্ট্রের নেতৃত্ব মানে দায়বদ্ধতা, আত্মশুদ্ধি ও জনগণের পাশে থাকা। কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে থাকা একজন প্রাক্তন মন্ত্রী যেন শাসকশ্রেণির প্রতিচ্ছবি—অন্ধ ক্ষমতার শিকার হয়ে ইতিহাসের প্রান্তে ছিটকে পড়া এক নাম।

তিনি কি আবার ফিরবেন? আদালতের মুখোমুখি হবেন? না কি বিদেশেই গড়ে তুলবেন নতুন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ? সময়ই হয়তো একদিন এই প্রশ্নের জবাব দেবে।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়