প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৯
৫৩ বছরের সাধনা শেষে স্বপন সেনগুপ্তের প্রস্থানে অপূরণীয় শূন্যতা

চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনে কিছু নাম চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকে, যাঁদের জীবন হয়ে উঠে এক একটি প্রতিষ্ঠান। এমনই একজন ছিলেন সংগীত গুরু স্বপন সেনগুপ্ত (১৯৫১-২০২৪)। সুদীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি শুধু সুর শিক্ষা দেননি, বরং চাঁদপুরকে উপহার দিয়েছেন সংগীতের একটি মজবুত ভিত্তি। গত ২৭ নভেম্বর ২০২৫ ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর প্রয়াণ কেবল একটি মানুষের চলে যাওয়া নয়, যেনো ঘটলো চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনের একটি যুগের সমাপ্তি। সংগীত জীবনে ৫৩ বছরের সাধনা শেষে তাঁর প্রস্থানে অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি হলো চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনে।
তাঁর জীবনের সিংহভাগ জুড়ে ছিলো চাঁদপুর শহরের ঐতিহ্যবাহী ‘চাঁদপুর সংগীত নিকেতন’। ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত টানা প্রায় ৫৩ বছর তিনি এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এই দীর্ঘ সময়কালে তাঁর আন্তরিকতা, নিয়মানুবর্তিতা এবং সংগীতের প্রতি গভীর নিষ্ঠা সংগীত নিকেতনকে এক নির্ভরযোগ্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত করেছিলো। তাঁর এই শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর জীবনব্যাপী সংগীত সাধনা এবং শিক্ষকতার মাধ্যমে অসংখ্য শিল্পী সৃষ্টি তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
স্বপন সেনগুপ্তের সবচেয়ে বড়ো পরিচয় ছিলো তিনি একজন সফল ‘সংগীত-দ্রষ্টা’। তিনি কেবল সুরের স্বরলিপি শেখাতেন না, তিনি শিক্ষার্থীদের ভেতরে সংগীতের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ এবং সঠিক উচ্চারণ শৈলী গেঁথে দিতেন। তাঁর হাতে তৈরি অসংখ্য শিক্ষার্থী আজ দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে পরিচিত।
স্বপন সেনগুপ্তের শিক্ষকতা কেবল পাঁচ বছর মেয়াদী কোর্স শেষ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। তাঁর শিখন পদ্ধতিতে ছিলো গভীর যত্ন ও আদর্শের ছাপ। তাঁর হাত ধরেই বহু শিল্পী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর সুযোগ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এস ডি রুবেল, গজলশিল্পী রুহুল আমিন বাদল, ভারতের সংগীত শিক্ষাবিদ রজত চক্রবর্তী, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের শিল্পী বাবুল চক্রবর্তী, শংকর আচার্যী, রিয়া চক্রবর্তী, কল্লোল সেনগুপ্ত ও পুতুল দাস সহ আরও অনেকে। এই প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাই স্বপন সেনগুপ্তের সাফল্যগাথা বহন করে চলছেন।
বলা যায়, চাঁদপুর সংগীত নিকেতন ছিলো স্বপন সেনগুপ্তের হাতে গড়া এক শিল্পী তৈরির কারখানা, যেখানে তাঁর কঠোর কিন্তু স্নেহপূর্ণ নির্দেশনায় হাজারো প্রতিভা বিকশিত হয়েছে।
চাঁদপুর শহরের কদমতলা নিবাসী এই গুণী ব্যক্তিত্ব তাঁর জীবনসঙ্গী কণ্ঠশিল্পী মিরা সেনগুপ্তের সাথে এক সাথেই সংগীত সাধনা করে গেছেন। তাঁদের পারিবারিক জীবন ছিলো সংগীতময়তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন সফল পিতা। তাঁর দু ছেলে ডা. কৌসিক সেনগুপ্ত এবং কল্লোল সেনগুপ্ত।
স্বপন সেনগুপ্ত শুধু একজন একক শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন চাঁদপুরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি অপরিহার্য অংশ। তাঁর মতো মানুষই নীরবে, নিভৃতে একটি জনপদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি মজবুত করে তোলেন। তাঁর চলে যাওয়ায় চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনে যে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে, তা প্রমাণ করে সংস্কৃতি অঙ্গনে তাঁর প্রভাব ও গুরুত্ব ঠিক কতোটা ব্যাপক ছিলো।
স্বপন সেনগুপ্ত এবং চাঁদপুর সংগীত নিকেতন এক ও অভিন্ন। এই প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করেছে, সঠিক প্রশিক্ষণ ও পরিবেশে যে কোনো জেলা থেকেও দেশবরেণ্য শিল্পীর জন্ম হতে পারে। অধ্যক্ষ স্বপন সেনগুপ্তের প্রয়াণ এক গভীর শূন্যতা তৈরি করলেও তাঁর হাতে গড়া সুরের ধারা চাঁদপুরবাসীর কাছে একটি গৌরবময় ঐতিহ্য, এক অবিনশ্বর সুরধারা হয়ে থাকবে।






