বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ যৌথ বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ চেকপোস্ট ৯০ যানবাহনে তল্লাশি।। ১২ মামলায় ৬০ হাজার টাকা জরিমানা, ৬ গাড়ি জব্দ
  •   হরিণা থেকে দু মাদক ব্যবসায়ী আটক
  •   কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৩৯ জনের তথ্য চেয়েছে দুদক

প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২৯

সংস্কৃতিপ্রেমীদের মনে স্মৃতির জানালায় নব্বই’র দশক

ছায়াছন্দের সাদাকালো দিনগুলো

কবির হোসেন মিজি
ছায়াছন্দের সাদাকালো দিনগুলো

একটা সময় ছিলো, যখন শুক্রবার আসতো সেইদিন সন্ধ্যা আর রাত মানেই ছিলো এক অন্যরকম উৎসব। এক টুকরো আনন্দের নাম ছিলো ছায়াছন্দ, আর সাদাকালো টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠা বাংলা সিনেমা ছিলো সেই আনন্দের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। নয়নের ভেতর গেঁথে থাকা সেই স্মৃতির পাতাগুলো আবারও জীবন্ত হয়ে উঠে, যখন কোনো এক নিঃশব্দ দুপুরে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে চোখে পড়ে এমন একটি পোস্ট, ৯০ দশকে বিটিভিতে ছায়াছন্দ অনুষ্ঠান এবং ছায়াছবি প্রচার নিয়ে আপনাদের স্মৃতিটুকু তুলে ধরবেন কি?

এই এক লাইনের প্রশ্ন যেন খুলে দিলো অনেকের স্মৃতির সেই পুরোনো স্মৃতির ডায়েরি, যেখানে ভরপুর হাসি, আলো, সংগীত আর ছাদে ওঠা চিৎকার। স্মৃতি শুধু ব্যথা নয়, স্মৃতি হয়ে উঠে একসময় ফিরে না আসা জীবনের প্রতিচ্ছবি।

তখন সবার ঘরে টিভি ছিলো না, তবু ঘরে ঘরে ছিলো বিনোদন ও আনন্দের ঠিকানা। আর পুরোনো দিনের সেই বাংলা গানের ছায়াছন্দ আর ছায়াছবি নিয়ে ফেসবুকের সেই পোস্টে অনেকেই তাদের হারানো দিনের স্মৃতিকথা তুলে ধরেছেন। কমেন্টে তাদের সেই স্মৃতিকথা নিয়েই এই প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হলোÑ

সাদাকালো টেলিভিশন চৌদ্দ ইঞ্চি নিজেদের ঘরে ছিলো না, অন্যের ঘরে দৌড়ে গিয়ে দেখতে বসতাম এভাবেই স্মৃতি কুড়িয়ে তুলে এনেছেন জাহাঙ্গীর আলম হৃদয়।

টেলিভিশন মানেই ছিলো মহল্লার উৎসব

একটা সময় ছিলো যখন টেলিভিশন মানেই ছিলো একটি পরিবারের সম্পদ নয়, পুরো মহল্লার উৎসব। শুক্রবার সন্ধ্যায় নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সবাই মিলে একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখার সেই পরিবেশ আজ আর কল্পনাতেও আসে না। মানুষের ভিড়ে জায়গা পেতাম না, এই বাক্যটুকু শুধু ভিড় বোঝায় না, বোঝায় মানুষের ভেতরে গড়ে ওঠা একান্ত সামাজিক বন্ধন, যা হারিয়ে গেছে আধুনিকতার দৌড়ে।

স্মৃতি বড়ই মধুর

রিফাত কান্তি সেন লিখেছেন, স্মৃতি বড়োই মধুর। আর সংস্কৃতিমনা বাঙালির কাছে স্মৃতি মানেই এক অদ্ভুত বিনোদন জগত, ছায়াছবি আর ছায়াছন্দ যেন ছিলো হৃদয়ের স্পন্দন। দিন যায়, সময় পাল্টায়, কিন্তু ঠিক সেই সময়কার দিনগুলো আজও কথার মতো বেঁচে থাকে। কত শত স্মৃতি আঁকড়ে বড়ো হয়ে উঠে মানুষ। সে খবর কেউ রাখে না, তবু তা রয়ে যায় অন্তরে। ছায়াছবি আর ছায়াছন্দের ইতিহাস টানার আগে আসলে একটু জেনে নেওয়া দরকার, কেমন ছিলো সে সময়ের বিনোদনের নিজস্বতা। আধুনিকতার মারপ্যাঁচে প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। সাদাকালো থেকে রঙিন দুনিয়ায় মানুষ এখন স্বপ্ন দেখে। কিন্তু রঙের চেয়েও স্বপ্নময় ছিল সেই সাদাকালো দিনগুলো। টেলিভিশনের পর্দা তখন ছিলো এক স্বপ্নের জানালা, আর সেই জানালা দিয়ে যে আনন্দ দেখা যেতো, তা আজকের হাজার চ্যানেলে আর দেখা মেলে না।

দিন গোণা হতো সিনেমার জন্যে

বিলকিস খান লিখেছেন, প্রতি সপ্তাহে দিন গুণতাম, কখন বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার আসবে। আর সেই দিন এলে শুরু হতো টেলিভিশনের ঝিরঝির শব্দ। অনেক সময় চ্যানেল ক্লিয়ার না হলে বাড়ির ছাদে উঠে অথবা গাছে উঠে কেউ এন্টেনা ঘোরাতো, নিচে থেকে কেউ নির্দেশ দিতো, এই, এই এবার ঠিক আছে, ভালো আসতেছে! একটু ডানে ঘোরাও!

আর তখনই দেখা যেতো হুমায়ূন ফরিদী, আতাউর রহমান, আফজাল হোসেন কিংবা শাবানা-কবরী-সুজন-সুজাতার সিনেমা, এই ছিলো আমাদের বিনোদনের রাজ্য।

এন্টেনা ঠিক করা ছিলো এক রীতিমতো যুদ্ধ

৯০-এর দশকের যারা ছায়াছন্দ আর ছায়াছবির দর্শক ছিলেন, তারা সবাই জানেন যে সাদাকালো টিভি দেখতে গেলে শুধু

বিদ্যুৎ থাকলেই চলতো না, দরকার ছিলো সিগন্যালÑআর তা আসতো একটি মাত্র উৎস থেকে,

সেটি এন্টেনা।

মনির হোসেন মন্তব্যে বলেছেন, এন্টেনা ঠিক করা ছিলো একটা ঝামেলার কাজ।

বাহ্যিকভাবে এন্টেনার ঝামেলা হলেও, তখনকার জন্যে এটি ছিলো এক ধরনের পারিবারিক অভ্যাস।

কেউ ছাদে উঠতো, কেউ নিচে থেকে গলা চড়িয়ে দিক নির্দেশনা দিতো, এইভাবে করো, না না ডানে ঘোরাওৃ ওহ্ এইবার ভালো আসতেছে!

কারও হাত ফাঁসিয়ে যেতো, কারও গামছা বাতাসে উড়তো, সব মিলিয়ে একটা টিমওয়ার্ক, একটা মিলেমিশে কাজ করা হতো।

এই কাজটুকু শুধু প্রযুক্তিগত দুর্বলতা নয়, এটি ছিলো পারিবারিক সম্প্রীতির বাস্তব রূপ। আজ আমরা রিমোট হাতে একা বসে থাকি, তখন সবাই মিলে একটি অনুষ্ঠান দেখার আগে পর্যন্তও এক ধরনের মধুর সঙ্কল্প কাজ করতো।

ছায়াছন্দ মানেই সাপ্তাহিক মিলনমেলা

ছায়াছন্দ অনুষ্ঠান ছিলো বিটিভির একটি সংগীতভিত্তিক

চলচ্চিত্র অনুষ্ঠান, যেখানে বাংলা চলচ্চিত্রের গান প্রচার হতো নির্দিষ্ট শৈল্পিক বিন্যাসে।

খাদিজা মাহাবুব লিখেছেন, অনুষ্ঠানটি শুরুর আগ থেকে বসে থাকতাম, প্রতি সপ্তাহে হিসাব করতাম কবে আসবে সেদিন।

এই একটি অনুষ্ঠান ঘিরেই গড়ে উঠতো একাধিক পরিবারের যৌথ আনন্দঘন পরিবেশ। ঘরভর্তি শিশুদের হাসি, মায়েদের ফিসফিসে গল্প, আর পিতাদের ব্যস্ততা, সব মিলিয়ে ছায়াছন্দ হয়ে উঠতো ছোটখাটো পূর্ণদৈর্ঘ্য উৎসব।

গানের মধ্যে ছিলো মধুর সুর

আজ যেখানে গান মানেই শোরগোল, অর্ধনগ্নতা আর

অতিনাটকীয়তা, তখনকার গান ছিলো আবেগ আর হৃদয়ের সমন্বয়।

এ.

এম. সাদ্দাম হোসেন লিখেছেন, গীতিকার লিখে গান

সুরকার দেয় সুর

সুর ও ছন্দে

শিল্পীর কণ্ঠে

হয়ে উঠে সুমধুর...

এই কথাগুলোই বলে দেয়, ৯০ দশকের গান মানেই ছিলো ছায়াছন্দের সুরেলা মধুর ক্ষণ। স্মৃতি মানে শুধু দর্শক নয়, অংশগ্রহণও।

রেডিওতে গানের আসরে চিঠি পাঠাতাম

আলমগীর হোসেন আঁচল লিখেছেন, রেডিওতে গানের আসর অনুষ্ঠানে চিঠি বা টেলিগ্রাম পাঠাতাম গান শোনার জন্যে, পরে নিজের নাম শুনে মুগ্ধ হতাম।

তাঁর কথায় বোঝা যায়, দর্শক শুধু দর্শক ছিলো না, তারা ছিলো সম্পৃক্ত। বিটিভির চিঠিপাঠ-ভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলোতে নিজেদের নাম শুনে গর্বে বুক ভরে যেতো শিশু কিংবা কিশোর হৃদয়। এখনকার ফেসবুক বা ইউটিউব কমেন্টস সেই উত্তেজনার সমান নয়।

হারিয়ে যাওয়ার বেদনা

মো. শওকত করিম, অনন্ত জয়, জাহিদ নয়নসহ অনেকে যেন একই সুরে লিখেছেন, সেই দিনগুলো খুব ভালো ছিলো। এই একটি লাইনে আটকে আছে একযুগের সারাংশ। যে সময়ের মানুষ ছিলো পরস্পরের, সম্পর্ক ছিলো নিঃস্বার্থ, আনন্দ ছিলো সমষ্টিগত। আজকের দিনে সেই সময়কে ফর্মালিনহীন সময় বলা যায়। তখন অভিনয় হতো হৃদয় দিয়ে, গান হতো মন ছুঁয়ে, সম্পর্ক হতো ভরসায়। আজ সবটাই যেন অনুকরণ আর অভিনয়ের ছায়ায় ঢাকা।

সময়ের যান্ত্রিকতা আমাদের ছুটি দিয়ে এনেছে সামনে। কিন্তু কিছুই কি থেকে যায় না পেছনে? ছায়াছন্দ আজ আর নেই, কিন্তু তার ছায়া রয়ে গেছে আমাদের স্মৃতিতে। সেই সাদাকালো দিনগুলোকে আমরা আর ফিরিয়ে আনতে পারি না, কিন্তু সংরক্ষণ করতে পারি গল্পে, লেখায়, হৃদয়ে।

হয়তো কোনো এক শুক্রবারে, মনের ভেতর বাজবে সেই পুরোনো ছায়াছন্দের সুর, আর আমরা চুপিচুপি ফিরে যাবো এক হারানো দিনে, যেখানে সবাই ছিল একসাথে।

স্মৃতির মেঘলা দিনগুলো

ফরহাদ খন্দকার যেন নব্বই দশকের দৃশ্যপট তুলে ধরেছেন

চোখের সামনে।

তিনি তার অনুভূতি জানিয়ে লিখেছেন, মেঘগাইভার, সিন্দাবাদ,

রবিনহুড, আলিফ লায়লা। বাংলা ছায়াছবি ও ছায়াছন্দ দেখার জন্যে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার অন্যের বাড়িতে পাটি নিয়ে গিয়ে সবাই একসাথে সময় কাটানোর আরেক নাম ৯০-এর দশক।

আজকের দিনে মানুষ সিনেমা দেখে একা, কানে হেডফোন লাগিয়ে। কিন্তু তখন সিনেমা মানেই ছিলো গোষ্ঠিগত আনন্দ, একসাথে দারুণ বলে ওঠা, একসাথে কাঁদা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়