প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৫
তবুও স্টিমার সার্ভিসটি চালু হোক

গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সুসংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম হয়েছে ‘পর্যটক সার্ভিস হিসেবে স্টিমার চালু হচ্ছে মধ্য নভেম্বরে’। সংবাদটিতে লিখা হয়েছে, নৌপরিবহন উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, তিন বছর আগে বন্ধ হওয়ে যাওয়া স্টিমার আবারও চলবে। ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চালু করা হচ্ছে এই যাত্রীসেবা। তবে তা বাণিজ্যিকভাবে নয়। শুক্রবার (২৪ অক্টোবর ২০২৫) সকালে সদরঘাটে স্টিমার ‘পিএস মাহসুদ’-এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে যোগ দিয়ে এ কথা জানান তিনি। এ সময় নৌ উপদেষ্টা বলেন, নভেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে চলবে স্টিমারটি। ঢাকা থেকে বরিশাল রুটে চলাচল করার পরে চাদঁপুর রুটেও চলবে স্টিমার। উপদেষ্টা জানান, নতুন প্রজন্ম ও বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে দেশীয় ঐতিহ্য তুলে ধরতে এ সার্ভিস চালু থাকবে। তবে বাণিজ্যিকভাবে নিয়মিত চলবে না।
যাত্রীরা বলছেন, তারা আবারও যেমন ঐতিহ্যবাহী স্টিমারে ভ্রমণ করতে পারবেন, তেমনি দক্ষিণাঞ্চলের নদীপথগুলোর সঙ্গে মানুষ পরিচিত হতে পারবে। স্টিমারের মাস্টাররা বলছেন, ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর স্টিমারসেবা বন্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে দেড়শ’ বছরের ঐতিহ্য থেমে যায়। তিন বছর পর আবার চালু হওয়ায় খুশি তারা। তবে সেটি চালু হচ্ছে সপ্তাহে একদিনের জন্যে। বিআইডব্লিউটিসির একটি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিনে দুটি স্টিমারের পুনর্বাসন কাজ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে পানিতে চালানো হয়েছে। সাজসজ্জার কিছু কাজ বাকি, এখন সেগুলো চলছে। এরপর সার্ভেসহ অন্য আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে একটি স্টিমার ঢাকা-বরিশাল নৌপথে পর্যটক সার্ভিস হিসেবে যুক্ত হবে। আপাতত একটি স্টিমার সপ্তাহে একদিন চলাচল করবে। এ ছাড়া ঢাকার আশপাশে কেউ ভাড়া নিয়ে ভ্রমণ করতে চাইলে সেই সুযোগ রাখা হবে।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, স্টিমারের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৮৮৪ সালে। কয়লাচালিত প্যাডেল স্টিমার প্রথমে নারায়ণগঞ্জ ও পরে ঢাকা থেকে খুলনার নৌপথে চলাচল করতো। পথে চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, মোরেলগঞ্জ, হুলারহাট, সন্ন্যাসী, কাউখালী ঘাটে যাত্রাবিরতি দিতো। ঔপনিবেশিক সময়ে খুলনার সঙ্গে ভারতের রেল যোগাযোগ শুরু হলে নৌপথে যাত্রী পরিবহন গুরুত্ব পায়। তখন বহরে ছিলো ফ্লোটিলা কোম্পানির ১৪টি স্টিমার। পরে পিএস গাজী, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচা, পিএস টার্ন, পিএস সেলার মতো ঐতিহ্যবাহী স্টিমারের সংযোজন ঘটে। এই স্টিমারগুলোর মধ্যে চাঁদপুর-গোয়ালন্দ রুটে চলাচলকারী স্টিমারও ছিলো। যে স্টিমারে আসাম থেকে মেইল ট্রেনযোগে যাত্রীরা চাঁদপুর এসে গোয়ালন্দ গিয়ে কলকাতা অভিমুখী ট্রেনে চড়ে পশ্চিমবঙ্গে যেতো। আবার পশ্চিমবঙ্গের যাত্রীরা গোয়ালন্দ এসে স্টিমারযোগে চাঁদপুর পৌঁছে আসামমুখী ট্রেন ধরতো। ভারতের এ দুটি রাজ্যের মধ্যে এমন যাতায়াত ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে। এর ফলে ‘গেট ওয়ে অব আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’ কিংবা ‘গেট ওয়ে অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ হিসেবে চাঁদপুরের খ্যাতি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেলেও বাস্তবে হারিয়ে যায়। চাঁদপুর থেকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত জাতীয় রেল সড়কের অস্তিত্বও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এতে রেলকেন্দ্রিক চাঁদপুরের সোনালি অধ্যায়ের চিরঅবসান ঘটে। স্মৃতি হিসেবে জরাজীর্ণতা ও বেদখলে আক্রান্ত রেলওেয়ের শত শত কোয়ার্টার এখনও রয়ে গেছে চাঁদপুরে।
আমরা মনে করি, বাণিজ্যিকভাবে না হোক, পর্যটক সার্ভিস হিসেবে ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল রুটে ঐতিহ্যবাহী স্টিমার চালুর ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিসি যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে অনেক বড়ো সুখবর। এজন্যে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমাদের বিশ্বাস, স্টিমারপ্রিয় যাত্রীদের চাহিদায় পুনরায় বাণিজ্যিকভাবে চালু হতে পারে স্টিমার সার্ভিস। এতে নিস্তব্ধতায় আক্রান্ত চাঁদপুর স্টিমার ঘাটটি আবার সরব হবে, যাত্রীদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠবে। আর বিআইডব্লিউটিসির অলস সময় কাটানো কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মমুখর হবে। মধ্য নভেম্বরে চালু হতে যাওয়া পর্যটক সার্ভিসের আওতায় স্টিমারযোগে আগত দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পদচারণায় ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর আপাতত মুখরিত হোক-সে প্রত্যাশা করছি।




