শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৮

ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দীন বীর উত্তমের অন্তিম যাত্রা

হাসান আলী
ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দীন বীর উত্তমের অন্তিম যাত্রা

অত্যন্ত গভীর বেদনা ও শ্রদ্ধার সাথে আজ আমরা স্মরণ করছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় আকাশযোদ্ধা, মহান মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন আহমদ, বীর উত্তমকে। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি। জাতির সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি শুধু একজন যোদ্ধা নন, তিনি ছিলেন সাহস, দায়িত্ববোধ এবং মানবিকতার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাঁর প্রস্থান আমাদের হৃদয়ে শোকের ভার এনে দিয়েছে, তবে তাঁর বীরত্বগাথা আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন সমগ্র বাংলাদেশ দখলদার বাহিনীর যাঁতাকলে বিপর্যস্ত হতে বসেছিল, তখন অল্পসংখ্যক দেশপ্রেমিক তরুণ নিজেদের জীবনের সমস্ত নিরাপত্তা বিসর্জন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তির লড়াইয়ে। তাঁদের মধ্যে ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন আহমদ ছিলেন অন্যতম। তিনি যোগ দেন কিলো ফ্লাইট নামের এক বিশেষ আকাশযোদ্ধা ইউনিটে—যা ছিলো বাংলাদেশের প্রথম এয়ার কমব্যাট ইউনিট। সামান্য সম্পদ, সীমিত প্রযুক্তি এবং ভয়ংকর ঝুঁকির মধ্যেও এই ইউনিটের সদস্যরা শত্রুর বিরুদ্ধে আকাশপথে আঘাত হানার সাহস দেখিয়ে ইতিহাসে তৈরি করেন নতুন অধ্যায়। সেই অভিযানে ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন আহমদের বীরত্ব ও বিচক্ষণতা বাংলাদেশকে নতুন আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, স্বাধীনতার সংগ্রামকে বাতাস দিয়েছে নতুন গতি।

যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি শুধু আঘাত হানেননি, তিনি ছিলেন অসাধারণ মনোবলের প্রতীক। সহযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, আকাশযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং শত্রুকে বুঝিয়ে দিয়েছেন—বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাঁর এই অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে। এটি শুধু একটি সম্মাননা নয়, এটি একটি জাতির কৃতজ্ঞতা, একটি ইতিহাসের স্বাক্ষর। তাঁর নাম উচ্চারণ করলেই গর্বে বুক ভরে উঠে।

কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন আহমদের বীরত্ব শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিলো না। জীবনের শেষ মুহূর্তেও তিনি মানবিকতার এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি ১৬ অক্টোবর মৃত্যু বরণ করেন এবং মৃত্যুর পর নিজের দেহ ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের এনাটমি বিভাগে দান করেছেন মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে। তাঁর দেহ গ্রহণ করেছে কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে। তিনি দেখিয়ে গেলেন—দেশপ্রেম শুধু যুদ্ধে রক্তদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মৃত্যুর পর দেহদান করাও এক উচ্চমানের মানবিক সেবা। আগামী প্রজন্মের চিকিৎসকরা তাঁর দেহ থেকে শিখবেন মানব শরীরবিদ্যা, শিখবেন দায়িত্ববোধ এবং হয়তো হৃদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধি করবেন—দেশপ্রেম মানে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মানুষের পাশে থাকা।

আজকের এই সময়, যখন মানবিকতা ও মূল্যবোধ নানা টানাপোড়েনে নিমজ্জিত, সেই সময়ে ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন আহমদের জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে একজন মানুষ বীরত্ব ও বিনম্রতার সমন্বয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে যেতে পারে। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সাহসের এক আলোকবর্তিকা। তাঁর মৃত্যু আমাদের শোকাহত করেছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করে—দেশের প্রতি ভালোবাসা মানে শুধু অস্ত্র ধারণ করা নয়, বরং দায়িত্ব, ত্যাগ ও নৈতিকতার চর্চা করাও।

জাতি আজ গর্বের সাথে তাঁকে স্মরণ করছে। তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই এবং প্রার্থনা করি—বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণ তাঁর জীবন থেকে প্রেরণা গ্রহণ করুক।

বীরের রক্তধারা কখনও থেমে থাকে না, ইতিহাস তাঁকে চিরকাল ধারণ করে রাখবে।

লেখক : বীর উত্তমের ঘনিষ্ঠজন এবং দেহদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়