রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৭

নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্য

বিমল কান্তি দাশ
নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্য

এই হাওড়-বাঁওড়, নদ-নদী, খাল-বিল, পাহাড়-মালভূমি, বন-জঙ্গল, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত-ম্যানগ্রোভ অঞ্চল, একটি মাত্র স্থান থেকে সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় অবলোকন স্থান কুয়াকাটাসহ প্রকৃতির এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের সাথে আছে আরো অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উৎসস্থল বাংলাদেশের সুন্দরবনটি। কবির লেখনীর আঁচড়ে আর ভাস্করের তুলির ভাস্কর্যে এই বাংলার বহুধা প্রাকৃতিক রূপগুলো আপন গুণে গুণান্বিত হয়ে জ্যোতিষ্কের মতো আপনাআপনিই জ্বলজ্বল করছে সেই সুদূর নীল নভমণ্ডলের গায়ে। প্রায় চার সহস্রাধিক বছর পূর্বে রোমান ও গ্রিকদের কাছে এই বাংলার নাম ছিলো ‘গঙ্গারিডাই’। তখনকার বৈদিক যুগের এই বাংলা পারস্য-আরব এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কে যুক্ত ছিলো। তখন বাংলার রাজধানী ছিলো গৌড়। যখন বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত-কলা এবং স্থাপত্যেরে প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। এই সময়টি ছিলো ১১শ’ এবং ১২শ’ শতাব্দীতে এবং ১৩শ’ শতাব্দীতে মুসলমান সুলতান এবং বার ভূঁঞাসহ হিন্দু রাজন্য বর্গের দ্বারা এই বাংলা শাসিত হয়েছিল। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর মোঘল বাংলা ছিলো একটি ‘সুবাহ্’, যেখানে যুক্ত ছিলো বর্তমানের বাংলাদেশ-ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং ওড়িশ্যা। কিন্তু বাংলাদেশ ছিলো উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। মোঘল সুবাহ্ বিস্তৃত ছিলো ১৫৭৬-১৭৫৭ পর্যন্ত। বাংলার প্রথম নবাব ছিলেন মুর্শিদ কুলী খান আর শেষ নবাব ছিলেন মির্জা সিরাজ-উদ-দৌলা। এই বাংলা পরাধীনতার করাল নিষ্পেষণ থেকে স্বাধীন হয়েছে বার বার। কিন্তু তার স্বকীয়তা কখনো বিসর্জন দেয় নি।

এই বাংলা মানুষকে শিখিয়েছে যৌথ পারিবারিক নিষ্ঠা, আত্মিক সংবেদনশীলতা, পারস্পরিক সহমর্মিতার অটুট বন্ধন। বাংলার আবহমান কালের সংস্কৃতিকে মানবতার পরাকাষ্ঠায় উজ্জীবিত রাখার প্রয়াস আর শিখিয়েছে আন্তরিক আতিথেয়তায় বাঙ্গালিত্বের বৈশিষ্ট্য। আরো অতিরিক্ত শিখিয়েছে তিনটি অদৃশ্য ইন্দ্রিয় মন-বুদ্ধি-অহংকার কে সংযত রেখে প্রকৃত মানবতাসম্পন্ন মানুষ হওয়ার ‘ছবক’। মানুষ মানুষকে ছলে-বলে-কলে কৌশলে পণ্য করে, কিন্তু সমজাতীয় বন্য পশু ও পরস্পরকে পণ্য করে না। পশুর প্রায় সকল পাশব চরিত্রই অবয়বিক মানুষ রপ্ত করে ফেলেছে, শুধু পারে নাই কুকুরের নিষ্কলুষ অকৃত্রিম প্রভু ভক্তিকে আয়ত্তে আনতে। আর বিড়ালের পোষ্যতার অবিচলতাকে বশে আনতে। কুকুরের প্রভুভক্তিকে নকল করে শুধুই দ্বি-চারিতায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছে। আর বিড়ালের পোষ্যতার পরিচয় দিয়েছে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস না করে।

আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশটি আয়তনে বিশ্বে বিরানন্নবইতম, আর বিশাল জনসংখ্যায় ৮ম বৃহত্তম। দেশটি আজ নানাবিধ অশান্তিতে নিমজ্জিত। এ দেশের আদি মানুষগুলো চিরকালই প্রেম প্রীতি-সহানুভূতি-সংবেদনশীল এবং উৎকৃষ্ট মানবতায় শ্বেতশুভ্র মানুষ হিসাবে উন্নতদেশগুলোর চাইতে অনেকটাই ইতিবাচক ছিলো। কিন্তু আজ কতিপয় অতৃপ্ত ক্ষমতাবাজ-ক্ষমতা আগ্রাসী-পরশ্রীকাতর-দ্বিচারিতাপুষ্ট এবং তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ প্রবণতার উন্মত্ততা সমৃদ্ধ বাংলার এককালের শাসক গোষ্ঠীর দৃশ্যমান কুপ্রবৃত্তি দেশটাকে আজ পঙ্কিল সলিলে অবগাহন করায়েছে। বাংলাদেশের সামাজিক দ্বিধা-বিভক্তি অব্যাহতভাবেই চলে আসছে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবস্থাটা ক্রমেই নিম্নমুখী হওয়ার প্রতিফলনে দেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবেই চলছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি অগণিত এবতেদায়ী মাদ্রাসা-কওমী মাদ্রাসা এবং অনিবন্ধিত বহু প্রাথমিক শিক্ষালয়। ফলে মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষাটায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ মেরুদণ্ডী করার পরিবর্তে দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার দিকে ঠৈলে দিচ্ছে। ফলে মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষার ভিৎটাই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। যা ভবিষ্যৎ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যে অশনি সংকেত। যে কোনো রাষ্ট্র পরিচালকের জন্যেই যে মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন তা হলো, মাতৃভাষার নৈতিকতাবহুল অভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন করা, যা মাধ্যমিক শিক্ষার ভিতকে প্রগাঢ় করবে। যে ধারা উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত চলমান থাকবে এবং শিক্ষিত বেকাররা জাতির বোঝা হবে না।

একটি ইউটিউব পরিসংখ্যানে জানা গেল : বাংলাদেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯টি। এর মধ্যে সরকারের অধিভুক্ত আছে ৬৫ হাজার ৬১৬টি আর বাকিগুলো অনিবন্ধিত অথবা কিন্ডারগার্টেন। প্রত্যেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে অগণিত মক্তব-প্রাথমিক বিদ্যালয়-একাধিক জুনিয়র এবং সিনিয়র মাদ্রাসা। যেগুলোতে তিন ধারায় শিক্ষাদান চলছে, যা একটা বাংলাদেশী শিশুর মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতার অতীত। এতে মাতৃভাষায় শৈশব শিক্ষাটা উপেক্ষিত হচ্ছে। ফলে এদেশের দ্বিচারী রাজনীতিবিদ-উন্নয়ন পাগল সজ্জিত নেতা-আমলা-সুশীল সমাজ-শিল্পপতি এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ তাদের উত্তরসূরিদেরকে দেশের বাইরে কোনো উন্নত দেশ থেকে চিকিৎসা এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রয়াসে সাধ্যাতীত প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে যায় এবং দেশের উন্নয়নের তরে কৃত্রিম মায়াকান্নায় বুক সিক্ত করে ফেলে। জাগতিক শক্তির আধার হলো পদার্থ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আধার হলো জনগণ,নজনগণের শক্তির আধার হলো মাতৃভাষায় মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষা। সৌহার্দ্য এবং পরমতসহিষ্ণুতার মানবিক চর্চায় আমরা সহস্র যোজন পিছিয়ে আছি বলেই আমরা শিষ্ঠাচার বর্জিত কুৎসিত আচার আচরণে অভ্যস্ত হয়েছি। গণতন্ত্রকে লালন করতে হয় নৈতিক শিক্ষা এবং চর্চা দিয়ে। অশ্লীল-অশিষ্টাচার এবং মনমানসিকতায় নিম্নগামী প্রবণতাসম্পন্ন সমাজে কোনো দিনও তিমির বিদারী সভ্যতা বিকশিত হয় না। যে বাণীতে মাদার তেরেসা অমর হয়ে আছেন তাহলো : The fruit of silence is prayer, the fruit of pray is faith, the fruit of faith is love, the fruit of love is service, the fruit of service is peace.

পৃথিবীর ১৯৫টি স্বাধীন দেশে প্রায় আট বিলিয়ন বিভিন্ন সংস্কৃতিমনালোক বসবাস করে আসছে। বিভিন্ন সংস্কৃতির আবেশে এরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষে মানুষে প্রীতি ও মৈত্রীর শান্তিময় বন্ধনে বসবাস করে আসছে। এটাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। এর বিচ্যুতিতে সৃষ্টি হয় পারস্পরিক মনান্তর। যা থেকে সৃষ্টি মতান্তরের প্রতিচ্ছবি হলো ধর্ম বিশ্বাসের নামান্তর। সৃষ্টির মধ্যে সুন্দরতম জীব হলো মানুষ। এই পাক ভারত উপমহাদেশে মানুষ মানুষকে পণ্য করেছে ১৯৪৭-৪৮-৫০-৫২-৬৪-৬৬-৬৯-৭১-৭৫-২০০১ এবং ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ লাখ লোক। প্রচলিত ধর্মগুলো সবই সর্বোচ্চ মানবতার তরে সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু ধর্মের জন্যে মানুষ সৃষ্টি হয় নি। জন্মের পর প্রত্যেক মানব সন্তানই একটা বিশেষ সংস্কারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মী হয়ে যায়। মানবতার সমর্থনে একেকটি ভাবনা একেকটি তারা হয়ে আকাশে জ্বলজ্বল করবে। তাই উদাত্ত কণ্ঠে বলতে হয় :

ধন্য তুমি বাংলাদেশ! এ পৃথিবী

অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে যে রয়;

মতান্তরের বিষ ফোঁড়া সারা গায়

দ্বিচারী শাসক যত উন্নয়ন খাদক হয়॥

নিবেদন এই যে, Make Bangladesh great again with a humanly square deal.

লেখক : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়