প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:১৯
৩১ পদের বিপরীতে ২৪ জনই যখন থাকে না-

চাঁদপুর সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) ও প্রাক-বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চলছে ভয়াবহ জনবল সংকট। দীর্ঘদিন ধরে নতুন নিয়োগ না হওয়ায় ৩১টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৭জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। বাকি ২৪টি পদই শূন্য থাকায় প্রতিষ্ঠান দুটির কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আর এই লোকবল সংকটের মধ্যেই শিশু পরিবারের কার্যক্রম চলছে প্রায় ৮ বছর ধরে। বর্তমানে কর্মরত আছেন তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) ১জন, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ১জন এবং গ্র্যাজুয়েট শিক্ষক ৫টি পদের মধ্যে আছেন ২জন। তবে সহকারী শিক্ষক ৪টি পদই শূন্য থাকায় শিশুদের নিয়মিত ক্লাসের পাশাপাশি প্রাইভেট বা কোচিং করার সুযোগও নেই। এতে তাদের শিক্ষার মান ভয়াবহভাবে পিছিয়ে পড়ছে। তাছাড়া কারিগরি প্রশিক্ষক পদ শূন্য থাকায় বৃত্তিমূলক বা হাতে-কলমে শিক্ষা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে শিশুরা ভবিষ্যতের জন্যে কোনো পেশাগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে না। মেট্রন কাম-নার্সের ২টি পদই শূন্য থাকায় আবাসিক কন্যাশিশুদের স্বাস্থ্যসেবা ও নিয়মিত তদারকি বিঘ্নিত হচ্ছে। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। একইভাবে কুক বা রাঁধুনীর ২টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় খাবার সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়েছে। বাইরের লোকজনকে ভাড়া করে সাময়িক ব্যবস্থা করা হলেও এতে শিশুদের স্বাস্থ্যকর ও মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অফিস সহায়ক পদে ৭টির মধ্যে মাত্র ২জন কর্মরত থাকায় প্রশাসনিক কাজ ও দৈনন্দিন কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া কম্পাউন্ডার না থাকায় ওষুধ ব্যবস্থাপনা ও প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আছে। হিসাব রক্ষক পদে লোকবল না থাকায় আর্থিক কার্যক্রমও সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। অন্যদিকে প্রাক-বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৩টি ইন্সট্রাক্টর পদের সবক’টিই শূন্য থাকায় শিশুদের জন্যে বিভিন্ন ট্রেড কোর্স চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে তাদের কারিগরি শিক্ষার স্বপ্ন ভেঙ্গে পড়ছে।
জানা যায়, সরকারি শিশু পরিবারের মোট আসন সংখ্যা ১৭৫টি হলেও বর্তমানে ৯৯ জন কন্যাশিশু বসবাস করছে। এর মধ্যে বৃদ্ধার জন্যে নির্ধারিত রয়েছে ১০টি আসন। তবে এতো বিপুল সংখ্যক শিশুকে মাত্র ৭জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর নির্ভর করে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিশুদের পড়াশোনা, স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক বিকাশ ও দৈনন্দিন জীবনযাপন সব ক্ষেত্রেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। শিশু পরিবারের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা অল্প লোকবল নিয়েই সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু সহকারী শিক্ষক পদগুলো খালি থাকায় শিশুরা সঠিকভাবে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে না। তারা প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়তেও পারছে না। এতে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। সরকারি শিশু পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক ছায়েফ উদ্দিন জানান, আমাদের এখানে অনেক লোকবল সংকট রয়েছে। ৩১টি পদের মধ্যে মাত্র ৭জন দিয়ে চলছে পুরো শিশু পরিবারের কার্যক্রম। মেট্রন কাম-নার্স, কুক এবং কারিগরি প্রশিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় শিশুদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রতি মাসেই আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেই। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ না হলে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। অভিভাবক ও স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছেন, শিশু পরিবারে নিয়োজিত লোকবল একটি শিশুর জন্যে সঠিক যত্ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার। অথচ বছরের পর বছর শূন্যপদ পূরণ না করায় এসব এতিম ও অসহায় শিশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তারা মনে করেন, দ্রুত শূন্যপদ পূরণ করে লোকবল সংকট নিরসন করা না হলে প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়ে যাবে।
জনবল সংকটে চাঁদপুরের সরকারি শিশু পরিবারটি বড়ো ধরনের অসহায়ত্বে ভুগছে। তারপরেও বিদ্যমান সাত কর্মকর্তা-কর্মচারী সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ৯৯ জন আবাসিক এতিম মেয়েশিশুর যে অভিভাবকত্ব করছেন, সেটা অনেক বড়ো কিছু। কথা হলো, দেশে এতো শিক্ষিত বেকার থাকা সত্ত্বেও এ শিশু পরিবারটিসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান শূন্যপদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না কেন? সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এ শিশু পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসকের আহ্বানে কিছু সমাজসেবামূলক সংগঠন উপকরণগত, এমনকি জনবলের সহযোগিতা নিয়ে হাত বাড়িয়েছে। বিশেষ করে চাঁদপুর রোটারী ক্লাব এই শিশু পরিবারে ‘পাঠ সহজিকরণ প্রকল্প’ চালু করে প্রতি সপ্তাহের দুদিন ৮জন শিক্ষক দিয়ে এতিম শিশুদের পাঠদান করার ব্যবস্থা করেছে। রোটারী ক্লাবের পাশাপাশি যদি অন্য কোনো সংগঠন এতিমদেরকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতো, তাহলে তারা শিক্ষাগ্রহণ শেষে আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ হতো। স্মর্তব্য, বেসরকারি সংগঠনের সরকারি প্রতিষ্ঠানে সহযোগিতা সাময়িক হয়, টেকসই খুব কমই হয়। সেজন্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় চাঁদপুরের সরকারি শিশু পরিবারে জনবল সংকট নিরসনের লক্ষ্যে যতো দ্রুত সম্ভব কার্যকর উদ্যোগ নেয়াটাই বাঞ্ছনীয়ই হবে।