প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২৫
বাউল গানে প্রবীণ জীবন

বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতিতে বাউল গান একটি ব্যতিক্রমী সংগীত ধারা, যা শুধু বিনোদন নয় বরং দর্শন, মানবতাবাদ, আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার গভীর আলোচনাও বহন করে। বাউল গান মানুষের দেহ, আত্মা এবং সৃষ্টিকর্তার মাঝে সম্পর্ক নিয়ে গান রচনা করেন। এই গানগুলোতে মানবজীবনের প্রতিটি ধাপ শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য ও মৃত্যুর প্রতিফলন ঘটেছে।
বাউল গানগুলোতে প্রবীণ জীবনকে খুবই মর্মস্পর্শী ও দার্শনিক ভাবে তুলে ধরা হয়। বার্ধক্য নিয়ে যাঁরা বাউল গান রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : লালন সাঁই, দুদ্দু শাহ, রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, পাগলা কানাই, শাহ আবদুল করিম ও বিজয় সরকার।
নিচে তাঁদের কয়েকটি গান পাঠকদের কাছে তুলে ধরলাম।
লালন সাঁই-এর গান
১. ‘বয়স হলে দেহের ভরে/ হাড়ে হাড়ে ব্যথা ধরে’
২. ‘এখনো জাগে না মন, কবে জাগবি রে’
৩. ‘দেহের মধ্যে দেহ আছে, বার্ধক্য সে আর ধরা দেয় না’
৪. ‘আমার বয়স হলো যত, তত মনে পড়ে মৃত্যুর কথা’
৫. ‘আমার হাড়ের গুঁড়ি বাজায় বাঁশি’
৬. ‘দেহ ক্ষয় হয় দিনে দিনে, মন তবে বুঝে না কেন’
৭. ‘এই দেহ খাঁচার পাখি একদিন উড়ে যাবে’
৮. ‘এই দেহখানি মরিবে একদিন, বার্ধক্যে তার প্রমাণ মেলে’
৯. ‘এ দেহ খাঁচার পাখি একদিন উড়ে যাবে’
লালন সাঁই দেহতত্ত্ব, মৃত্যু চিন্তা ও আত্মিক জাগরণে প্রবীণ জীবন ব্যাখ্যা করেছেন।
দুদ্দু শাহ-এর গান
১. ‘যৌবন গেল মরে, বার্ধক্য এলো ঘরে’
২. ‘যৌবন যায়, বুড়ো বয়সে সাধন হয় না’
৩. ‘যৌবন গেল মিছে, সাধন হলো নাহি’
৪. ‘এখন বার্ধক্য এসেছে দেহে, মন তবে মিথ্যে আশায়’
রাধারমণ দত্তের গান
১. ‘বৃদ্ধ বয়সে কে দিবে সেবা, দেহ যখন অচল হয়’
২. ‘যৌবন যায়, বুড়ো বয়সে সাধন না হয়’
৩. ‘বয়স হল, দেহের জরা ধরিল, দাঁতে দাঁত লাগে আর’
৪. ‘যৌবন গেলে আর ফিরবে না, হায়! বার্ধক্যে সবই শূন্যতা’
হাছন রাজার গান
১. ‘লোকে বলে, বলে রে ঘর বাড়ি ভালা না আমার/ কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরই মাজার’
২. ‘মরিলে কান্দাবে কে, বার্ধক্যে ভরসা নেই’
৩. ‘বার্ধক্য এলো দোরে, কে দিবে সেবা গো আমার’
৪. ‘মানুষ ধীরে ধীরে মরে, দেহ ক্ষয়ে যায় বার্ধক্যে’
৫. ‘যৌবন গইল মোর, বুড়ো হইলাম রে ভাই’
পাগলা কানাই-এর গান
১. ‘বয়স হলে হাড়ে হাড়ে ব্যথা ধরে, চোখে অন্ধকার নামে’
২. ‘এ মন, বার্ধক্যে তোর হাল ধরবি কে?’
৩. ‘বয়স হইল পঞ্চাশ, কীর্ত্তন করে নাই আশ’
৪. ‘জীর্ণ দেহের ভরসা, দাঁত পড়েছে, চোখে আর দেখে না ভাই’
৫. ‘পঁচাত্তর বছর পেরাইয়া, সাধের দেহ আজ ভাঙে’
শাহ আবদুল করিমের গান
১. ‘যৌবন গেল, বার্ধক্য এলো দোরে/ সাধন করবি কেমনে রে বন্ধু, দেহ অচল শরীরে।’
২. ‘বয়স বাড়ে, দেহ হয় ক্ষয়/মনের মায়া তবু ছাড়ে না কভু।’
৩. ‘বয়স হলে চোখে ঝাপসা, দেহে লাগে ব্যথা/মনে তবু মিথ্যা আশা, দিন যাবে বা ফুরাই’
৪. ‘যৌবন কালে দেখার সাধ মেটে নাই / বার্ধক্যে এলো, দেহ হলো শিথিল’
বিজয় সরকারের গান
১. ‘বার্ধক্যে মরণ আসে, তরুণ কালে নাই সে ভাসে’
২. ‘বয়স হলে দেহে আসে নানা রোগ ব্যাধি’
৩. ‘বার্ধক্যে দেহ পড়ে ঝরতে, কইবে কে সান্ত্বনা’
৪. ‘যৌবন গেলো বার্ধক্য এলো, কে আছে আমার সাথী’
৫. ‘দেহ রে এই দেহ বার্ধক্যে জীর্ণ হবে’
বাউল গানে জীবনের অস্থায়িত্ব,বার্ধক্যের দুঃখ কষ্ট, শরীরে ক্ষয় আর মৃত্যুর অনিবার্যতার কথা গভীর ভাবে প্রকাশ করেছে। গানগুলো জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছানো মানুষের হাহাকার, হতাশা আবার কখনো ঈশ্বর ভক্তি ও মোক্ষ প্রত্যাশার সুর মিশে আছে।
বাউল গানে প্রবীণ জীবন মানে শুধু দেহের ভগ্নতা নয় বরং জীবনের শেষ হিসেব, নিঃসঙ্গতা, মৃত্যু চিন্তা এবং আত্মিক মুক্তির অন্বেষা। এসব গানে প্রবীণরা জীবনের সত্য উপলব্ধি করেÑশরীর নশ্বর কিন্তু আত্মা অনন্ত।