প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৯
ধারাবাহিক উপন্যাস-১১
নিকুঞ্জ নিকেতন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৭.
বলতে বলতে কয়েকটা মাস চলে গেল এভাবেই। আমাদের প্রত্যেকের জীবন এখন একে অপরের সাথে জুড়ে আছে। একজনকে ছাড়া অপরজন ভাবনাটা অসম্ভব। ক্যারাম নিয়ে তো প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন ঘটে। এখন আড্ডাটা বেশ জমছে নিকুঞ্জ নিকেতনে। অনিমেষ ও সারোয়ার ক্যারামের দুর্দান্ত জুটি। এরা দুজন মনযোগ দিলে জিতে উঠা বেশ কষ্টকর তাই জিততে হলে অন্তত সারোয়ারকে অন্যভাবে মাতিয়ে রাখতে হয়। যদিও অনিমেষ বহু আগেই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে কিন্তু পিটার পুরোপুরি নয়। তার মনের যন্ত্রণাগুলো হয়তো অনিমেষের চাইতেও প্রখর। সত্যি বলতে কীÑআপনজনের ব্যথাটা সহ্য করার মতো মানসিকতা সহজে গড়ে ওঠে না আর হবেই বা কীভাবে আমাদের প্রত্যাশাগুলো থাকে তাদের প্রতি অনেক। মানব জীবনে ত্যাগী হওয়া যদিও অনেকাংশে কষ্টকর তবুও হতে পারাটা একটা সাধনা। ত্যাগী হতে পারি না বলেই সর্বদা নিজেকে ভোগীর কাতারে পাই। ভোগে সুখ নয় ত্যাগেই সুখ কথাটা জানি তবে মানতে পারি না আর পারি না বলেই আমাদের কর্ম কখনো নিঃস্বার্থ হয় না। আমরা বিনিময় প্রথায় বিশ্বাসী কারণ কারো জন্য কিছু করলে তার বিনিময় প্রত্যাশা করি। হোক সেটা অপরিচিত বা কোনো আপনজন নতুবা সন্তান। সন্তানদের লালন-পালন করি তাদের গড়ে তুলি নিজের সর্বস্ব দিয়ে আর প্রত্যাশা থাকে শেষ বয়সটায় যখন চারপাশ অপরিচিত হয়ে উঠবে তখন ভরসার দেওয়াল হিসেবে পাশে থাকবে তারা। এই চাহিদাটুকু কী এতই বেশি যে সন্তানরা পেরে উঠে না? আর যখন পেরে উঠে না তখনি নিজেকে সর্বস্য হারানো লোকটার মতো অসহায় মনে হয়। শত আপনজনের ভীড়েও আপনজনকে তখন আর খুঁজে পাই না। সমস্যা যেখানেই হোক না কেন জীবনের মূলমন্ত্র হোকÑ“মরে যাওয়ার আগে বারবার মরা যাবে না আর মৃত্যুর আগে জীবনকে পঁচতে দেওয়া যাবে না। বাঁচতে হবে বীরের মতো কারণ জীবন যুদ্ধে আমিও কভু ছিলাম বীর যোদ্ধা”। কথাটা আমি বিশ্বাস করি কিন্তু বাকি তিনজনকে কীভাবে বুঝাই। হয়তো আমার সমস্যাগুলো তাদের চেয়ে কম তাই এমনটা ভাবতে পারি কিন্তু বাঁচতে হলে তো বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র মনে গেঁথে নিতে হবে। নাহ্ প্রতিদিন একই রুটিনে চলে আমাদের একঘেয়েমিতা চলে এসেছে। নতুনভাবে কিছু করা প্রয়োজন আবার ভয়ও লাগে কারণ বয়স তো আর আগের মতো নেই। দৌঁড়-ঝাঁপ, হৈ-হুল্লোর করে সকলকে মাতিয়ে নিতে পারব কিন্তু দৈনিক রুটিনের বাইরে একটু বেশি কিছু করতে গেলেই হাঁপিয়ে উঠি। ভাবছি এদের নিয়ে বাইরে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসব। এদিকে রাজীবের আসার সময় হয়ে এসেছে। আমি ও বিশাখা আমরা দুজন ব্যক্তি রাজীবকে নিয়ে হরহামেশা আলোচনা করে থাকি। গত কয়েকদিন যাবত সে আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় আর কত দিন আছে। মেয়েটার পাগলামি দেখলে অবাক লাগে আবার হাসিও পায়। ওরা দুজনে ছোটবেলার বন্ধু তাই আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক আবার ভাবি এর চাইতেও বেশি কিছু নয় তো! থাকলে ক্ষতিই বা কী? মেয়েটা চোখের সামনে গড়ে উঠেছে তাছাড়া রাজীব আর সে একসাথে বড় হয়েছে দুজন দুজনকে ভালোভাবে বুঝতে পারে। ওরা দুজনে যদি নিজেদের নিয়ে ভাবে আমার মনে হয় দুটি পরিবারের কারই সমস্যা থাকার কথা না। মেয়েটা দেখতে যেমন সুশ্রী তেমনি লক্ষীমন্ত ও সাংসারিক স্বভাবের। রাজীবের জন্য যদি বধূ বেশে কাউকে কল্পনা করি তাহলে বিশাখার চাইতে ভালো কেহ খুঁজে পাব বলে আমার মনে হয় না। কথাগুলো শুধু আমার মনের ভাবনা বাস্তবতায় তা কতটুকু কার্যকরী সেটা ওদের ওপরই নির্ভর করছে। আবার দেখা গেল আমি যা ভাবছি তা ভুলও হতে পারে কারণ বন্ধুত্ব আর জীবনসঙ্গীর ব্যবধানটা অনেক তাই মিছে ভাবনার কোনো বাস্তবিক রূপ হয় না।
‘কী রে মা কোথাও যাচ্ছিস?
‘না... তোমার কাছেই আসছিলাম। একটা বিষয় নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করতে চাই।’
‘আমার সাথে আলোচনা যেহেতু তাহলে বুঝতে হবে ঝামেলা বেশ জটিল।’
‘অতটা জটিল না, তবে বলতে পার। সমস্যা হলো আমার জব করা নিয়ে। বাপিকে বললাম আগামী সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলে আমি পুরোপুরি বেকার কোনো কাজ থাকবে না ফাইনালের পর। তাই সময় কাটানোর জন্য হলেও আপাতত ছোটখাট একটা জব করতে চাইছি।’
‘করতেই পার এটা তো ভালো একটা উদ্দ্যোগ, তাহলে সমস্যা কোথায়?’
‘সমস্যা আমার বাবা-মা। তাদের কথা মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছু করা যাবে না। আচ্ছা কাকাবাবু তুমি নিজেই বল পরীক্ষার পর আমি বাকি কয়েক মাস কীভাবে কাটাব? ’
‘সত্যি বল তো বেকার সময়টা কাটাতে চাইছিস বলেই কী জব করা নাকি টাকা-পয়সার বিষয়ও আছে।’
‘দুটোই। পরীক্ষার পর আমাকে বেকার থাকতে হবে না আর হাত খরচের টাকাটাও চলে আসবে।’
‘সেটা যদি থাকে তাহলে বলব তোকে চালিয়ে নেওয়ার মতো সক্ষমতা তোর অবিভাবকের আছে। পড়াশোনার ক্ষতি হবে চাকরি করলে এমনটা ভেবেই তোর বাবা হয়তো নিষেধ
করেছেন। তুই চাকরি করতে চাইলে তাদের এ ভুল ভেঙে বিশ্বাসটা তৈরি করে দেখিয়ে দিস ব্যাস হয়ে গেল। চাকরি করলে ছোটখাট কেন যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরি কর তার আগে নিজ যোগ্যতার শেষ ধাপটুকু পার কর।’
‘বুঝতে পারলাম তুমি আমার বিষয়ে বাবাকে সুপারিশ আর করছ না, তোমাদের সকলের একই চিন্তাধারা। তাহলে অবসর সময়টা আমার কীভাবে কাটবে?’
‘আমাদের মতো ঘুরে ফিরে, বই পড়ে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। মনে করবে দু-তিন মাসের জন্য অবসরে গিয়ে পেনশনে আছ।’
‘কাকাবাবু ভালো কথা মনে করিয়েছ তো! এবারের বই মেলায় নতুন লেখকদের বইগুলো কিনে আনব। পুরাতনরা তো প্রফেশনালি লিখে আর নতুন লেখকদের লেখনিতে একটা কাঁচা-পাঁকা অনুভূতি পাওয়া যায়। পড়তে ভালো লাগে বেশ। রাজীবের আসার তো আর বেশি একটা সময় বাকি নেই। বলতে বলতে দু মাস কেটে যাবে। আচ্ছা কাকাবাবু তুমি কোনো প্ল্যানিং করেছ নাকি?’
‘প্ল্যানিং! কোন বিষয়ে?’
‘রাজীবের আসা নিয়ে। বাহ রেÑছেলে এতদিন পর দেশে ফিরবে আর তার জন্য কোনো আয়োজন থাকবে না সেটা কী করে হয়।’
‘আমার তেমন কোনো প্ল্যানিং নেই তোর যদি কিছু থাকে তাহলে জানাতে পারিস। সেটাই না হয় হয়ে যাবে আমাদের প্ল্যানিং।’
‘আমার প্ল্যানিং, না-মানে-ইয়ে।’
‘আহা: এত ভনিতা কেন। রাজীব তোর ছোটবেলার বন্ধু তার আসাতে প্ল্যানিং থাকা অস্বাভাবিক কিছু না।’
‘না ভাবছিলাম গতবার তো কোথাও যাওয়া হয়নি সময় কম থাকায় এবার যেহেতু সময় করে ছুটি নিয়ে আসছে তাহলে বাইরে সবাই মিলে ঘুরতে গেলে কেমন হয়।’
‘কথাটা মন্দ নয় তবে নয়-দশ দিনের ছুটিতে আত্মীয়দের বাসায় নিমন্ত্রণেই চলে যাবে বেশ কয়েকদিন। সময় তখনি হয়ে ওঠে না।’
‘আমি জানি তোমরা দু-জন ঠিকই ঘুরে-ফিরে মজা করবে আমি বাদ যাব আর কী?’
‘হা হা হা... ঠিক আছে এবার যদি এমন কিছু প্ল্যানিং হয় তবে বলব তোকেও সাথে নিতে। এবার খুশি?’
কাকাবাবুর কথাগুলোয় কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছি। আগে এমনটা হতো না তবে এখন হয়। উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন মেয়ের মতো অথচ...আমি কী এর চাইতেও বেশি কিছু আশা করছি! মনের কোনে কোথাও একটু নিরেট অনুভব রয়েছে যাকে বাক্সবন্দি করে সেখানেই রেখে দিয়েছি যেন কারো সংস্পর্শে না আসে। অনুভূতিরা সুপ্ত বাসনায় ভর করে বেঁচে রয়েছে। কিছু অপেক্ষা, কিছুটা অভিমান আবার আবেগের স্্েরাতে তাকে বইতে হয় দূর বহুদূর। অনুভবগুলো নিতান্তই আমার যা তাকে বুঝিয়ে দিতে পারলে আমি দায়মুক্ত। আজকাল আমার চারপাশে কেমন একটা সৌরভ অনুভব করি, সবকিছুতে কেমন যেন মুগ্ধতা। হেমন্তের বাতাসেও কিছু আগমনী বার্তা বহন করছে। যেন চারপাশের সবকিছু আমার সেই অনুভবের সাক্ষী আর আমি ওদেরই একজনা। এই বাগান, চৌরাস্তার কাঠ-বাদামগাছ, এই রাস্তা, আকাশের সাদা মেঘগুলো আর বিকেলের দুষ্ট রোদ। ওরা কেউ কথা বলতে পারে না তবে বুঝিয়ে দেয় আমার ভাবনায় না আসা অনেক কিছু। এখন কেমন যেন একাকী থাকতে ভালো লাগে। একা বলতে শুধু আমি আর আমার চারপাশের কিছু না বলা এই বন্ধুগুলো। আবার ভাবি যাকে ঘিরে এই ভাবনার পৃথিবী সেও কী এমনটাই ভাবে? তার মনের অবস্থাও কী আমারই কাছাকাছি নাকি অন্য ধারায় বহে। আবার অভিমানী মনটা মাঝেমধ্যে অন্য কিছু ভাবে। সে এখন এক প্রতিষ্ঠিত ছেলে সুদুর পরবাসী। তার স্বপ্ন হয়তো আমার মতো একটা সাধারণ মেয়েকে ঘিরে থাকবে না, থাকবে তার মতোই কোনো প্রতিষ্ঠিত জন। তখন কী হবে? হয়তো দেখা যাবে বহুকাল লালন করা এই অনুভব তার কাছে সাধারণ নগণ্য কিছু। থাক এগুলো জমা, প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই। কিছু বলতে না পারাটা আফসোস আর বলে ফিরে আসা হবে বেদনার। মনে আফসোসটা থাক অন্তত নিজেকে বুঝাতে পারবÑবলতে পারলে হয়তো জয় আমারই হতো।
‘কী রে এখনো বসে আছিস এখানে? এ কী তুই কাঁদছিস?’
‘কাঁদছি! কৈ না তো?’
‘আমার চোখের জ্যোতি এতটা কমেনি যে তোর কান্না আমি দেখতে পাব না। বুঝতে পারছি অভিমান করেছিস। ঠিক আছে তোর বাবার সাথে আমি কথা বলব। জবই তো করতে চাইছিস এটা এমন কোনো অপরাধ না যে করা যাবে না।’
‘না কাকাবাবু তোমরা যেমনটা ভেবেছ সেটাই সঠিক। আমি মাস্টার্সের পরই জবের চেষ্টা করব।’
‘দ্যাটস লাইক এ গুড গার্ল। তোর এই বুঝটা জানিস রাজীবের মায়ের মতো। ও সবসময় চেষ্টা করত সামনের জন কী বলতে চাইছে, কেন বলছে এটা বুঝার আর এজন্যই তার সাথে কখনো ইচ্ছে করেও ঝগড়া করতে পারতাম না। জানিস দুটি মানুষ একে অপরে যদি বোঝে বা বোঝার চেষ্টা করে তাহলে ঝগড়া বিবাদ হওয়ার সুযোগই থাকে না।’
‘তুমি আজও কাকীমুনিকে ভুলতে পারনি তাই না।’
‘মা রে যদি সে শুধুই আমার স্ত্রী হতো হয়তো ভুলে যেতাম কিন্তু সে আমার পৃথিবীর একন্তই আপনজন তাই ভুলতে পারিনি। তুই এখন এগুলো বুঝবি না যখন বিয়ে করে সংসারী হবি তখন বুঝতে পারবি। এখন চল আমরা বের হই।
কাকাবাবু না চাইতেও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে দিলÑযদি সে শুধুই স্ত্রী হতো হয়তো ভুলে যেতাম কিন্তু সে আমার পৃথিবীর একন্তই আপনজন তাই ভুলতে পারিনি। কথাটা একটা সাধারণ বাক্য হলেও এর গভীরতা নিগূঢ়। তিনি আমার কাছে কখনো এমন কিছু বলেননি তবে আজ কোন আবেগে সেটা প্রকাশ করলেন জানি না। কারো প্রতি কতটা আবেগ থাকলে একটা মানুষ এভাবে এতবছর পরও সেরকম অনুভবে বেঁচে থাকে সেটা আজ প্রকাশ না পেলে বুঝতাম না। কিছু ভালোবাসা এভাবেই হয়তো বেঁচে থাকে অমরত্ব নিয়ে।
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় দেখুন]