শনিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১২

শিক্ষক দিবস এবং শিক্ষকতা

রাশেদা আতিক রোজী
শিক্ষক দিবস এবং শিক্ষকতা

শিক্ষকতা মহৎ পেশা, আর পঁাচটা পেশার মতো এটি নয়। কারণ, একজন শিক্ষক শুধু পড়ান না, সেই সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষমতার বিকাশ ঘটান এবং তাদের একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। একজন ভালো শিক্ষক হাজারো মোমবাতির সমান, যিনি নিজে জ্বলে অন্যকে আলো দেন।

শিক্ষক শুধু জাতি গড়ার কারিগর নয়, তারা পরামর্শদাতা, যত্নশীল অভিভাবক, পথপ্রদর্শক এবং এক কথায় পরিবারের মতো। তারা অসীম ভালোবাসা এবং ধৈযের্যর সাথে অসংখ্য ভূমিকা পালন করেন। তাই তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। প্রতি বছর একটি দিনকে বিশেষভাবে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

শিক্ষক দিবস বছরে একদিন ঘটা করে পালনের পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এটি শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এর গভীর তাৎপর্য আছে :

১. শিক্ষকদের অবদানকে স্বীকৃতি জানানো : শিক্ষকরা একটি জাতি ও সমাজের মেরুদণ্ড। তঁারা কেবল জ্ঞান বিতরণ করেন না, বরং শিক্ষার্থীদের চরিত্র, নৈতিকতা ও ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই বিশেষ দিনটি শিক্ষকদের সেই অসামান্য ও নিঃস্বার্থ অবদানকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানানোর একটি সুযোগ তৈরি করে।

২. শিক্ষকতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি : শিক্ষক দিবস পালনের মাধ্যমে সমাজকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই দিনটিতে শিক্ষক সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও চাহিদা নিয়েও আলোচনা করা হয়।

৩. কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ : এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিশেষ দিন, যেদিন তারা তাদের প্রিয় শিক্ষকদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ পায়। এই দিনে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষকদের সম্মান জানায়।

৪. ঐতিহাসিক কারণ ও প্রথা : বিভিন্ন দেশে শিক্ষক দিবস পালনের পেছনে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। যেমনÑভারতে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন (৫ সেপ্টেম্বর) উপলক্ষে দিবসটি পালিত হয়, যিনি একজন মহান শিক্ষক ও ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আবার, বিশ্ব শিক্ষক দিবস (৫ অক্টোবর) ইউনেস্কোর উদ্যোগে শিক্ষক অধিকার সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা গ্রহণের বার্ষিকী স্মরণ করে পালিত হয়।

৫. গুরু-শিষ্য সম্পর্ককে মজবুত করা : এই দিবসটি ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ ও মধুর করে তোলে। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে একটি আনন্দঘন ও ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

৬. পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি : শিক্ষক দিবস শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও মানোন্নয়নের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে, যা উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়ক।

সংক্ষেপে বলা যায়, বছরের অন্যান্য দিনও শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত, তবে একটি নির্দিষ্ট দিনে এই উৎসব পালন করা হয় যেন সমাজের সবাই একত্রিত হয়ে এই মহান পেশার প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে পারে এবং শিক্ষকদের প্রতি তাদের সম্মিলিত শ্রদ্ধা জানাতে পারে।

শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন’ বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের ভূমিকা ও কর্মপরিবেশের একটি আমূল পরিবর্তনের ওপর জোর দেয়। শিক্ষকতার গতানুগতিক ধারণাকে ভেঙে এটিকে একটি আধুনিক, গতিশীল এবং পারস্পরিক সমর্থনভিত্তিক পেশায় রূপান্তরের আহ্বান জানায়, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন। এবারের প্রতিপাদ্যটির মূল ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :

প্রচলিত ধারণা থেকে মুক্তি

একা শিক্ষক নন। ঐতিহ্যগতভাবে শিক্ষকতাকে একটি বিচ্ছিন্ন পেশা হিসেবে দেখা হয়, যেখানে একজন শিক্ষক ক্লাসরুমের চার দেয়ালের মধ্যে মূলত একাই সব দায়িত্ব পালন করেন। এই ধারণা শিক্ষকদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ায় এবং তঁাদের পেশাগত উন্নতিকে সীমিত করে।

এই প্রতিপাদ্য বিষয়টির মূল কথা হলো, এই একাকীত্ব থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষকতাকে এমন একটি পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সহযোগিতা বা ‘ঈড়ষষধনড়ৎধঃরড়হ’ হলো মূল চালিকাশক্তি।

কেন এই ‘পুনর্গঠন’ জরুরি?

শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি : যখন শিক্ষকরা একে অপরের সঙ্গে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, এবং সেরা পদ্ধতি বিনিময় করেন, তখন প্রতিটি শিক্ষকই আরও সমৃদ্ধ হন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা উন্নতমানের শিক্ষণ পদ্ধতি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ শিক্ষকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায়।

পেশাগত উন্নয়ন : শিক্ষকরা যখন সম্মিলিতভাবে কাজ করেন, তখন তঁারা একে অপরের কাছ থেকে শেখেন। এতে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিত্যনতুন শিক্ষণ কৌশল, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা বাড়ে।

মানসিক চাপ হ্রাস : একটি সহযোগী পরিবেশে কাজের চাপ ভাগ করে নেওয়া যায়। পাঠ্যক্রম পরিকল্পনা, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন বা কোনো শিক্ষার্থীর সমস্যা নিয়ে যৌথভাবে আলোচনা করলে মানসিক চাপ কমে এবং কাজের প্রতি সন্তুষ্টি বাড়ে।

শিক্ষক সংকট মোকাবেলা : যখন একটি পেশার পরিবেশ ইতিবাচক ও সহযোগী হয়, তখন তা মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে সাহায্য করে এবং বর্তমান শিক্ষকদের পেশা ছেড়ে যাওয়া (ঞবধপযবৎ ধঃঃৎরঃরড়হ) রোধ করে।

প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে প্রস্তাবিত সমাধান

জ্ঞানের সমবন্টন : শিক্ষকদের মধ্যে কার্যকর পাঠদান কৌশল, মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার সফল ধারণাগুলো নিয়মিত শেয়ার করা।

দলগত কাজ : একই বিষয়ের শিক্ষকমণ্ডলী মিলে একসাথে পাঠপরিকল্পনা প্রণয়ন, সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং সমাধান খেঁাজা।

পিয়ার সাপোর্ট নেটওয়ার্ক : নতুন ও প্রবীণ শিক্ষকদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক রিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হস্তান্তর হয়।

পেশাগত উন্নয়ন: ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণের পরিবর্তে সম্মিলিত ওয়ার্কশপ, সেমিনার এবং সমবায়ী শিক্ষার (ঈড়ষষধনড়ৎধঃরাব খবধৎহরহম) মাধ্যমে পেশাগত বিকাশ ঘটানো।

সংশ্লিষ্টদের জন্য করণীয়

এই প্রতিপাদ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকার—সবারই ভূমিকা রয়েছে :

শিক্ষকবৃন্দ : নিয়মিতভাবে নিজ সহকর্মীদের সাথে পাঠ পরিকল্পনা ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা; একটি ‘লার্নিং কমিউনিটি’ তৈরি করে একে অপরের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: শিক্ষকদের জন্য যৌথভাবে কাজ করার পরিবেশ ও সময় তৈরি করে দেওয়া; শিক্ষক দলগুলোকে (ঞবধস ঞবধপযরহম) উৎসাহিত করা; প্রতিষ্ঠান প্রধান কর্তৃক এই সহযোগী সংস্কৃতিকে সমর্থন ও নেতৃত্ব দেওয়া।

সরকার ও নীতিনির্ধারকরা : শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া; দলগত কাজকে উৎসাহিত করে এমন প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো তৈরি করা; অতিরিক্ত প্রশাসনিক চাপ কমিয়ে শিক্ষকদের মূল কাজে মনোযোগ দিতে সাহায্য করা।

বাস্তবায়নের সুফল

শিক্ষকের উন্নতি : শিক্ষকরা একে অপরের কাছ থেকে শিখে আরও দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন, যা পেশাগত মান বাড়ায়।

শিক্ষার্থীর লাভ : সহযোগিতার ফলাফল হিসেবে শিক্ষার্থীরা আরও বৈচিত্র্যময়, উদ্ভাবনী ও কার্যকর শিক্ষালাভের সুযোগ পায়।

বিদ্যালয়ের উন্নয়ন : একটি ইতিবাচক ও সহায়ক স্কুল সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা সামগ্রিক শিক্ষা পরিবেশকে উন্নত করে।

তাই শিক্ষকতাকে একটি শক্তিশালী, সম্মিলিত এবং উদ্ভাবনী পেশা হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানায়, যেখানে শিক্ষকরা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ না করে একটি বৃহত্তর শিক্ষণ সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে কাজ করবেন। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীÑউভয়েই উপকৃত হবে এবং শিক্ষার সার্বিক মান উন্নত হবে।

তাই বলবো শিক্ষক মানে শুধু পাঠদানই নয়, শিক্ষক মানে সঠিক পথে পরিচালনা, জীবনটাকে স্বপ্নের মত সুন্দর করে সাজিয়ে নেওয়ার মহান নির্মাতা।

রাশেদা আতিক রোজী : ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা প্রাইমারি এডুকেশন ট্রেনিং সেন্টার (ইউপিইটিসি), হাজীগঞ্জ চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়