প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫৩
অকালবোধনই দুর্গোৎসব

আসছে বছর আবার দেখা হবে--এই আশা আকাঙ্ক্ষা আর ভক্তি-শ্রদ্ধার মধ্যে দিয়ে দেবী দুর্গার চরণে প্রার্থনা জানিয়ে দশমী বিহিত পূজা শেষে আজ বিসর্জন হবে শারদীয় দুর্গোৎসবের। অশ্রুসজল বিষণ্ন বদনে ঘরে ফিরবে উৎসব উদযাপনকারী সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্তবৃন্দ।
ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, দেবী দুর্গা আজ স্বামী গৃহ কৈলাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন দোলায় চড়ে অর্থাৎ পালকিতে। আবার একটি বছর পর মায়ের আগমনকে কেন্দ্র করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ সকলের মাঝে সেতুবন্ধন হবে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনে সৃষ্টি হবে উৎসবের আমেজ, আরো জোরদার হবে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
পঁাচদিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসবের আজ বিসর্জন পর্ব। ব্যাপক আনন্দ উৎসাহের মধ্য দিয়ে পার হয়ে গেলো বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবের ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজা। আজ দশমীবিহিত পূজা শেষে অনুষ্ঠিত হবে বিসর্জন পর্ব। শেষ হয়ে যাবে একটি বছরের অপেক্ষার পালা। ধর্মীয় বিধিবিধান মতে, আসছে বছর আবার দেবী দুর্গা কন্যা রূপে ফিরে আসবেন তঁার পিত্রালয়ে। সন্তান দ্বারা মাতৃরূপে পূজিত হবেন পূজামণ্ডপে। সুখ, শান্তি, ঐশ্বর্য আর পুণ্য কামনার্থে অঞ্জলি প্রদান করা হবে দেবী চরণে।
দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা থেকে শুরু করে পূজা শেষে মায়ের ফিরে যাওয়ার সময়কাল পর্যন্ত (বিসর্জন পর্ব) বিরাজিত আনন্দ উৎসাহ একই মানদণ্ডে মূল্যায়িত হতে দেখা যায়। মায়ের বিদায় বেলায় থাকে না কোনো ব্যথার্ত হৃদয়ের আকুতি। কোনো কোনো পূজামণ্ডপে পূজার দিনগুলোতে বিরাজ করে অসহ্যকর পরিবেশ। পূজামণ্ডপে আয়োজকদের বিকট শব্দ সম্পন্ন ইকোর আওয়াজে পরিবেশ যেমন অসহ্যকর হয়ে উঠে, তেমনি চোখের পলক পড়তে না পড়তেই চোখ ধঁাধানো আলোক রশ্মির লুকোচুরিতে কষ্টকর হয়ে পড়ে মায়ের দর্শন প্রক্রিয়া। এমনি পরিস্থিতিতে অবচেতন মনে প্রশ্ন জাগে, মা তুমি স্থির আছো তো? শব্দ দূষণে তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? আনন্দের অতিমাত্রায় আমরা ভুলে যাই দেবী আছেন আমাদের মাঝে, তিনি জাগ্রত। খড়, মাটি দ্বারা নির্মিত মৃণ্ময়ী মূর্তিতে পুতঃ পবিত্র মন্ত্র দ্বারা তঁার মাঝে প্রাণের সঞ্চালন করা হয়। খড়, মাটি দ্বারা নির্মিত অবকাঠামোতে প্রাণ পেয়েছে প্রবল পরাক্রমাশালী মহিষাসুর মর্দিনী, জগৎ শান্তি প্রদায়িনী দেবী দুর্গা। সেই দেবী আরাধনা বা তার সন্তুষ্টিই আমাদের সকলের কাম্য। আমরা ভুলে যাই দেবী আরাধনায় আমাদের কী করা প্রয়োজন, কেমন হওয়া উচিত আমাদের পূজার আয়োজন। আমরা ভুলে যাই দেবালয়ের দেবতা বোবা নয়, তিনি জাগ্রত, তঁার ভেতরেও রয়েছে প্রাণের স্পন্দন। তিনি দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন। জগতের সব কিছুর ওপরই রয়েছে তঁার দিব্য দৃষ্টি। আমরা সাধনহীন, জ্ঞানহীন, ভজনহীন, ভক্তিহীন বলেই মায়ের এই দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন উপস্থিতি দেখতে পাই না। জগৎজননী মায়ের উপস্থিতি আমাদের বোধগম্য না হলেও জগত জুড়ে তিনি আছেন।
দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন মা দুর্গা আমাদের সকল কিছুই দেখতে পান। তাই আমাদের আচরণ ও আয়োজনে সংযত হওয়া উচিত। আমাদের কোনো কার্যক্রমেই যেন তিনি রুষ্ট না হন সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে একাগ্র চিত্তে।
দেবী আগমনে আমরা যেমন আনন্দিত হই, তেমনিভাবে পূজার দিনগুলোতে যেন আমরা ভক্তি শ্রদ্ধার সাথে মায়ের পূজা সম্পন্ন করতে পারি সেদিকেও আমাদের সমান দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। মায়ের পূজা দর্শনে কারো যেন কোনোরূপ ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকেও সমান দৃষ্টি দিতে হবে। দেবীর আগমন আর বিদায়বেলা এক হওয়া উচিত নয়। আনন্দ চিত্তে দেবীকে বরণ করলেও বিদায় বেলায় অশ্রুসজল নয়নে প্রার্থনা জানাতে হবে, মা তুমি আবার এসো, আমরা যেন এমনি করে সকলে মিলে তোমার পূজায় সামিল হতে পারি, সকলেই যেন ভক্তিভরে অঞ্জলি দিতে পারি তোমার রাতুল চরণে। সকল দুঃখ দুর্দশা পরিহার করে আমরা যেন তোমার আশীষে সুখে, শান্তিতে বঁাচতে পারি। মা তুমি দুষ্টের দমন করে আমাদের সকলের চিত্তে শান্তি দান করো, আমাদের অজ্ঞানহেতু সকল ভুলভ্রান্তি থেকে আমাদের তুমি ক্ষমা করো। তুমি কৃপা করে আমাদের রক্ষা করো। তোমার দেবালয় থেকে শুরু করে যারা আমাদের বাড়ি, ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর থেকে শুরু করে আমাদের মা, বোনদের সম্ভ্রমহানি করতে চায় তুমি তাদের বিনাশ করো। মা তুমি জগতের কল্যাণ করো।
লোকসমাজে ঘাপটি মেরে থাকা অসুরদের মনে যেন ভালোবাসার সৃষ্টি হয়, তাদের হৃদয়ে ন্যায় অন্যায় বিচারবোধ জাগ্রত করো। মা তুমি জগৎ কল্যাণকারী, তোমার কৃপা বর্ষিত হোক আমাদের সমাজ সংসারে।
আমরা ১২ মাসে ১৩ পূজা করি, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। অভাব অনটনই অনেকের নিত্য সঙ্গী হয়ে দঁাড়িয়ে থাকে গৃহ মাঝে। মানসিক অশান্তির মাঝেই অতিবাহিত হয় আমাদের সাংসারিক জীবন। এ সকল অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদেরকে একাগ্র চিত্তে প্রার্থনা জানাতে হবে দুর্গতি নাশিনী দেবী দুর্গার চরণে। মনে রাখতে হবে, দেবীর কৃপায় রাজা সুরথ তার হারানো রাজ্য ফিরে পেয়েছেন। মানসিক শান্তি ও সংসার ফিরে পেয়েছেন সমাধি বৈশ্য।
আমরা অনেকেই অজ্ঞাত রয়েছি দেবী দুর্গার অসীম দয়ার কাহিনী সম্পর্কে।
দুর্গাপূজা হলো কলির অশ্বমেধ যজ্ঞ। কলিকালে অশ্বমেধ যজ্ঞ হয় না। অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ করতে হলে দুর্গাপূজা করলে তার ফল লাভ হয়। একাগ্রচিত্তে যারা দুর্গাপূজা করেন তারা দেবীর কৃপা আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হন না। পঁাচদিনব্যাপী মায়ের পূজা সম্পন্নে যেমন জনবল, অর্থের প্রয়োজন হয়, তেমনি সমাজ সংসারে তঁার কৃপা লাভ হয় কল্পনাতীতভাবে।
সমাজ সংসার একত্রীকরণের বাস্তবতা নিয়েই দেবী আসেন আমাদের মাঝে। তঁার আগমনী বার্তা দিয়েই আমাদেরকে জানান দেন ঐক্যের বিকল্প নেই। তিনি পুত্র, কন্যাদেরকে সাথে নিয়ে আসেন বলেই সমাজ সংসারে সেই ঐক্য ফুটে উঠে। দেবী দুর্গা সর্বজীবে তিনি সংস্থিতা।
স্কন্দ পুরাণে উল্লেখ রয়েছে, দেবী দুর্গা হলেন শক্তির আধার। দুর্গা ও শক্তি পূজোর মধ্যে বিভেদ নেই। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ মতে, ত্রেতাযুগে অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীরাম রাবণকে বধ করার পর সীতাকে উদ্ধার করেন এবং দেবীদুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে দেবীর অকালবোধন করেছিলেন। সেই থেকেই শরৎকালে দুর্গাপুজোর প্রচলন শুরু। রাম চন্দ্র দেবের অকাল বোধনই হলো দুর্গোৎসব।