শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:০০

ভালোবাসার অদৃশ্য দেয়াল

উজ্জ্বল হোসাইন
ভালোবাসার অদৃশ্য দেয়াল

ছোট শহরে বসবাস করে আনিকা ও হৃদয়। দুজনেই চাকরিজীবী। তাদের সংসার নিস্তরঙ্গ নয় বরং চারপাশে দায়িত্বের ঝড় বইছে প্রতিনিয়ত। আনিকা একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক আর হৃদয় একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তাদের খুব ভোরে ঘুম ভাঙার পর থেকেই দিনের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। তাদের সংসার বলতে এক ছেলে ও এক মেয়ে। সন্তানদের জন্যে তাদের নিবিড় সাধনা। বড় ছেলে ইমরান ক্লাস সিক্সে আর মেয়ে ঐশী ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সকালে ভোরেই তাদের স্কুলের জন্যে প্রস্তুত করা, নাশতা বানানো, স্বামীর জন্যে খাবার গুছিয়ে দেওয়া সব কাজ আনিকা শেষ করেই স্কুলে যান। স্কুল শেষে তার নিজের টিউশনি, খাবার রান্না করা থেকে শুরু করে সংসারের সকল কাজ, বাচ্চাদের পড়াশোনা দেখা। আবার দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ানো তার নিত্য অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই নিজের দিকে খেয়াল রাখার একদমই সময় পায় না আনিকা।

হৃদয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। কিন্তু শুধু চাকরির আয়ে সংসার চালানো যায় না, তাই পাশাপাশি ছোট্ট একটি ব্যবসাও গড়ে তুলেছেন। হৃদয় সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে গেলেও অনেক সময় রাত দশটা না বাজলে ফেরা হয় না। ফিরেই আবার হিসাব-নিকাশের খাতা খুলে বসে পড়েন। এভাবেই চলে তাদের প্রতিদিন।

বিয়ের পরের দিনগুলোতে আনিকা আর হৃদয় ছিলো যেন অবিচ্ছেদ্য। সামান্য সময় পেলেই একে অপরের সঙ্গে গল্প করত, সিনেমা দেখতো, হাঁটতে যেত। আবার মাঝে মাঝে তারা দূর ভ্রমণেও বেড়িয়ে যেতো। তাদের ভালোবাসা কোনো অংশ কমতি ছিলো না। কিন্তু সংসারের চাহিদা আর দুই সন্তানের দায়িত্ব সেই দিনগুলোকে একে একে গ্রাস করে নিয়েছে।

রাতে যখন হৃদয় ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফেরে আনিকা তখনও রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকে। খাবার গরম করা, বাচ্চাদের বই গুছিয়ে রাখা, টিফিন প্রস্তুত করা এসব শেষ হতে হতে রাত গড়িয়ে যায়। হৃদয় তখন বিছানায় শুয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখে। দুজনের চোখে চোখ পড়লেও কথা হয়, হয়তো শুধুই কিছু প্রয়োজনীয় বাক্য

লবণ শেষ হয়ে গেছে।

বাচ্চার ফি জমা দিতে হবে।

গ্যাস বিল কবে দিবে?

তাদের ভালোবাসার নরম ছোঁয়া কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তবে এটাতে তাদের কোনো দোষ ছিলো বলে মনে হয় না। কারণ সংসার নামক নিয়তিই হয়তো তাদেরকে দূরে ঢেলে দিচ্ছে।

একদিন বিকেলে টিউশন শেষে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরছিল আনিকা। রাস্তায় দেখল এক দম্পতি পার্কে বসে হাসি-ঠাট্টা করছে। মেয়েটি স্বামীর কাঁধে মাথা রেখেছে। একজন অন্যজনের হাত ধরে বসে আছে। দৃশ্যটা আনিকার বুকের ভেতর হাহাকার তুলল। তার মনে পড়ল, শেষ কবে সে হৃদয়ের সঙ্গে এমনভাবে সময় কাটিয়েছে? মনে পড়ল না।

বাড়ি ফিরে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াল। মুখে নেই সেই সময়ের কোমলতা, মুখটা ক্লান্ত, চোখে কালি, ঠোঁটে নেই কোনো রঙ। কখন যেন সে নিজের যত্ন নেওয়া ভুলে গেছে। সংসারের বোঝা আর দায়িত্বের চাপে তার হাসি ফিকে হয়ে গেছে।

সেই রাতে আনিকা খেতে বসেন ছোট্ট করে বলেছিল

শোনো, আমাদের অনেকদিন কোথাও ঘোরা হয়নি।

হৃদয় মুখ তুলল না, শুধু বলল

সময় কই বলো তো? অফিস-ব্যবসা নিয়ে আমার দিন কেটে যায়।

আনিকাও চুপ করে গেল। ভেতরের কষ্টটা বুকের ভেতর জমে রইল। সেও মনে মনে ভাবলো এই মানুষটাতো এ রকম ছিলো না। তার মধ্যেও হাসি-ঠাট্টা এবং ভালোবাসায় ভরপুর ছিলো।

হৃদয়ের অবস্থাও অন্যরকম নয়। তবে আনিকার আবদার যে একেবারে অমূলক ছিলো তাতো নয়। হৃদয় ভেবেছে সংসারের চাহিদা মেটানোই তার মূল দায়িত্ব। অফিস থেকে ফিরেই হিসাবের খাতা মেলে বসে। তাদের ছেলে-মেয়ে ইমরান কিংবা ঐশী কাছে এসে গল্প করতে চাইলে সে বলে-

বাবা, এখন নয়। কাজ আছে।

সন্তানেরা দূরে সরে যাচ্ছে, আনিকার মুখে অভিমান জমছে এসব হৃদয় টের পেলেও ভেবেছে, এটা সাময়িক। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বছর কেটে যাচ্ছে, সম্পর্কের ভেতর অদৃশ্য দেয়ালটা যেন আরও উঁচু হয়ে উঠছে।

একদিন সন্ধ্যায় আনিকা রান্নাঘরে ব্যস্ত। হঠাৎ মেয়ে ঐশী এসে জিজ্ঞেস করলÑ

মা, তুমি আর বাবা কি আমাদের জন্যই সবসময় ঝগড়া করো এবং শুধু কাজ করো?

আনিকা থমকে গেল। আমরা তো ঝগড়া করি না মা।

ঐশী সরলভাবে বলল

তাহলে কেন তোমরা একসাথে বসে হাসো না? ক্লাসে আমাদের ম্যাম বলে, বাবা-মা যদি একে অপরকে ভালোবাসে, তাহলে বাচ্চারা খুশি থাকে। আমি তো দেখি না তোমরা একে অপরকে সময় দাও।

কথাগুলো আনিকার বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধল। রাতে বিছানায় শুয়ে সে কান্না চেপে রাখল। হৃদয় খেয়াল করল না, সে তখনো ফোনে ব্যবসার হিসাব লিখছে।

ক্রমেই আনিকা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়তে লাগল। মাঝে মাঝে ভাবতে,া ভালোবাসা কি শুধু শুরুতেই থাকে? সংসার কি কেবল দায়িত্ব আর টাকার হিসাবেই সীমাবদ্ধ?

অন্যদিকে হৃদয়ও টের পাচ্ছিল, সংসারের ভেতর কোথাও যেন শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেই শূন্যতাকে ভরাট করার সাহস বা উদ্যোগ দুজনের কারও ছিল না।

একদিন সকালে স্কুলে যেতে আনিকা একটু দেরি করেছিল। হৃদয়ও তখনও বের হয়নি। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকার ঘরে দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।

আনিকা বলল,

তুমি জানো, আমাদের বিয়ের প্রথম দিকে যখন বিদ্যুৎ যেত, তখন তুমি আমাকে ভয় না পেতে বলার জন্য হাত ধরে রাখতে।

হৃদয় থমকে গেল। দীর্ঘদিন পরে আনিকার কণ্ঠে এমন স্মৃতি ভেসে এল। সে ধীরে ধীরে বলল,

হ্যাঁ, মনে আছে। তখন তো শুধু তোমাকেই নিয়ে ভাবতাম। এখন সংসারের বোঝায়...

আনিকার চোখ ভিজে উঠল।

সেই দিন থেকে হৃদয় বদলাতে শুরু করল। রাতে ব্যবসার খাতা একপাশে রেখে বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করল, আনিকার পাশে বসে তার দিনের কথা শুনল। প্রথম প্রথম আনিকা বিশ্বাস করতে পারছিল না।

কয়েকদিন পর হৃদয় বলল..

শোনো, শুক্রবার আমরা সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে যাবো। অনেকদিন একসাথে সময় কাটানো হয়নি।

ইমরান-ঐশী উল্লাস করে চিৎকার দিল, তারা অনেক খুশি হলো। আনিকার চোখে সেই হারানো আনন্দের ঝিলিক ফুটল।

সেদিন তারা পার্কে গেল। বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করল, আনিকা ও হৃদয় একসাথে বসে হাসল। ঐশী দৌড়ে এসে বলল

দেখো! তোমরা আবার হাসছো। আমিও খুশি।

আনিকা হৃদয়ের হাতটা চেপে ধরল। হৃদয়ও দৃঢ়ভাবে তার হাত ধরে রাখল। দুজনের চোখে ভেসে উঠল একই প্রতিশ্রুতি

ভালোবাসা হয়তো ব্যস্ততায় চাপা পড়ে যায়, কিন্তু মরে না। যদি চাও, আবার নতুন করে জাগিয়ে তোলা যায়।

আনিকা ও হৃদয়ের সংসার এখনও ব্যস্ত। অফিস, টিউশনি, ব্যবসা সবই চলছে আগের মতো। কিন্তু তারা শিখেছে, দায়িত্বের ভিড়েও কিছু মুহূর্ত নিজেদের জন্য রাখতে হয়।

রাতে খাবার শেষে তারা একসাথে বারান্দায় বসে চায়ের কাপ হাতে গল্প করে। ইমরান-ঐশী খুশি হয়ে সেই দৃশ্য দেখে।

ভালোবাসার অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে গেছে, জায়গা করে নিয়েছে নতুন বিশ্বাস আর একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়