শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৬

ধারাবাহিক উপন্যাস-০৭

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
নিকুঞ্জ নিকেতন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

(৪)

বরাবরের মতো আমরা পার্কে মিলিত হই সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে। সারোয়ারের অবসর গ্রহণের পর থেকে আমরা প্রাণবন্ত সময় কাটাতে লাগলাম। কারো কোনো তাড়া নেই, প্রয়োজন নেই আছে অফুরন্ত সময়। মাঝে মধ্যে সে পাগলামি করে এটা সেটা নিয়ে সেটা ভিন্ন বিষয় কিন্তু সময় কাটানোর মতো উপকরণ সারোয়ার আমাদের প্রতিনিয়তই দিয়ে যায়। আমি ও অনিমেষ এখন তার প্রতি আসক্ত বলা চলে। তারপর হঠাৎ একদিন আমাদের বলে উঠেÑ

‘আজ একটু তাড়াতাড়ি বিদায় নিব।’

‘কেন?’

‘হাসপাতালে যেতে হবে।’

‘হাসপাতালে কেন? তোমার শরীর কী খারাপ লাগছে সারোয়ার।’

‘আরে না। আমার অনেক পুরানো কলিগ আবার ঘনিষ্ট বন্ধুও বলা যায়Ñপিটার গমস। কাল হঠাৎ আমাকে কল দিয়ে বলেছে সে হাসপাতালে ভর্তি আছে। আমাকে দেখতে চায়।’

‘তাই? তা উনার সমস্যাটা কী?’

‘সেটা জানি না। বিস্তারিত কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে সে অসুস্থ্য, হাসপাতালে ভর্তি। রাত থেকেই আমার কেমন যেন একটা অস্থিরতা কাজ করছে। পিটার অনেক উদার, পরোপকারী, বিশ্বস্থ ও ভালো মনের একটা মানুষ। চাকরির কয়েক বছর পর যখন রাজশাহীতে আমার পোস্টিং ছিল তখন তার সাথে পরিচয়। একটা সময় আমরা দুজনেই বন্ধুর মতো হয়ে উঠলাম। চাকরি ক্ষেত্রে দেখা যায় এক কলিগ অন্য জনকে বন্ধু কম প্রতিযোগী মনে করে কিন্তু পিটারের বিষয়ে তেমনটা ছিল না। আমি বহুবার তাদের বাসায় গিয়েছি। ভালো কিছু রান্না হলে পিটারের স্ত্রী আমাদের দাওয়াত করে খাওয়াতেন আর আমাদের অফিসের অনেকেই অপেক্ষায় থাকতাম পিটারের বাসায় খাওয়ার জন্য কারণ তার স্ত্রীর রান্নার এক অসাধারণ গুণ ছিল। আমি যে অন্য ধর্মীয় মানুষ তার বাসায় আসা যাওয়া করে বুঝতেই পারিনি। ট্রান্সফার নিয়ে আসার সময় আমার জন্য বেশ মন খারাপ ছিল তার আর আমারও একই অবস্থা। কর্মক্ষেত্রে কোনো কলিগের বন্ধু হওয়াটা সত্যি একটা অর্জন। সে আমার ছয় মাস আগে অবসর নিয়েছে। অনেক বছর তার দেখা নেই অথচ গত রাতে হঠাৎ তার কল পেয়ে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। তার জন্য মন বিচলিত হয়ে উঠে। এক কাজ কর দাদা তোমরাও আমার সাথে চল না হয়।’

‘সমস্যা নেই, কী বল অনিমেষ?’

‘আমার কোনো সমস্যা নেই আমি প্রস্তুত।’

‘তাহলে ঠিক নয়টায় আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি।’

সকাল নয়টা অনেক সময় ততক্ষণে আমরা নিজেদের কাজগুলো সেরে নেই। সারোয়ার সেদিন খুব অস্থিরতায় কাটিয়েছে, বারংবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে। আমি তার মনের অবস্থা বুঝতে পারেছি। এমনিতেই সদ্য অবসরে গিয়েছে সে তাই কর্মস্থলের টানটা এখনো ছুটেনি তার উপর কর্মজীবনের একটা বন্ধু অসুস্থ্য অর্থাৎ মনের ক্ষতটা আরও বাড়িয়ে দেওয়া। আমরা যথারীতি হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত। হাসপাতাল যদিও আমার তেমন একটা পছন্দের জায়গা না তবুও যেতে হলো। সুঠাম দেহী একটা মানুষকে অসহায়ের মতো হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকতে দেখলাম সেদিন। আশপাশে কেউ নেই তেমন। কোনো গুরুতর অসুখে দীর্ঘদিন ভুগেছে বলে আমার মনে হয়নি তবে সে অসুস্থ্য এটা বুঝতে পারি। ডিউটি ডাক্তারের সাথে সারোয়ার কথা বলছিল আর আমরা তার বিছানার পাশে দাঁড়ানো। হাসপাতালে যখন দেখতে যাই তখন জানতে পারি ডায়াবেটিসের মাত্রা ছিল ২৯। এজন্যই বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি আর ব্লাড সুগার বেশি থাকায় তার হয়েছিল শ্বাস কষ্ট, বুকে ব্যথার কারণ অনেকাংশে সেটাই। হাসপাতালে ২য় দিন গিয়ে দেখি তার কাছে আর কেউ নেই। সন্তানেরা যার যেমন কর্মব্যস্ততায়। সারাদিনে একবার এসে দেখে যায় তারপর পড়ে থাকে হাসপাতালের বিছানায় যেন বেঁচে থেকেও সে এই পৃথিবীর একটা জড় পদার্থ। অবশ্য তাদের কর্মজীবনের ব্যস্ততা থাকবে এটাই স্বাভাবিক তারপরও এই লোকটাকে কী কিছুটা সময় দেওয়া যায় না! আমরা প্রতিদিন যাই হাসপাতালে মানবিক কারণে আর গিয়ে সকালের আড্ডাটা সেখানেই শুরু হয় আবার বিকেলে গেলে সন্ধ্যা অবদি কাটে সেখানে। এই দু-চার দিনে আমাদের মধ্যে একটা আন্তরিকতা গড়ে উঠেছে। সপ্তাহের আগেই তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেয়। সেদিন তার সন্তানদের কাউকে তেমন একটা দেখা যায়নি। বড় ছেলের বউ নাম কোয়েল রড্রিক্স সে ছিল পাশে। পিটার এখন সুস্থ্য প্রায় কিন্তু মনের দিক থেকে তখনো অসুস্থ্য সেটা আমাদের প্রত্যেকের বুঝতে দেরি হয়নি। আমরা হাসপাতাল থেকে তাকে প্রথমত বাসায় পৌঁছে দেই তারপর একদিন আমি ও সারোয়ার মিলে নিয়ে আসি আমাদের আড্ডা পার্টিতে। তার শূন্যতাগুলোকে পাশ কাটিয়ে গতিশীল করতে আমাদের বেগ পেতে হয়েছিল বেশ। কাউন্সিলিং করে মটিভেট করার চেষ্টা করি আর তাতে কাজ হয়েছিল বলে আজ সে অনেকটা স্বাভাবিক। আমাদের এখন চারজনের জুটি হয়েছে। নিজের মতো করে চলাফেরা, আড্ডা দেওয়া, জগিং, ডাব খাওয়া ইত্যাদি বেশ ভালোই কাটে। এখন আর মনের কথা বলা মানুষের অভাব হয় না। নিজেদের সুখ-দুঃখ একে অপরে ভাগাভাগি করি। এদিকে সারোয়ারের মন আবার বেশ উদার। ওর মনের ভিতর কিছুই থাকে না আমাদের বলতেই হবে আর অন্যদিকে পিটার একটু ভিন্ন রকমের। কিছু একটা তার সমস্যা আছে আমরা বুঝি কিন্তু সে বলে না কভুও, নিতান্তই একজন ভদ্রলোকের মতো পাশ কেটে এড়িয়ে যায়। কেহ কিছু না বলতে চাইলে আমরা জোর করতে পারি না কারণ প্রত্যেকের জীবনে ব্যক্তিগত বলে একটা বিষয় আছে। পিটার প্রায়ই গ্যাপ দেয় আড্ডায় আবার অনেক সময় দেরি করে। আমরা মানিয়ে নিলেও সারোয়ারের সেটা হজম হবে না। প্রতিদিনই কিছু বলতে হবে তাকে। পিটারের বিষয়টা স্পষ্ট হয় তখনি যেদিন প্রথম আমরা তাকে খুঁজতে তার বাসায় যাই। সন্তানদের তার প্রতি আচরণ দেখে

সত্যি মনটা বেজার হয়ে গেল। একজন ভদ্রলোক কতটুকু সহনশীল হলে পরিবার-পরিজনদের রোষ প্রতিনিয়ত সহ্য করে। পিটারের কামাই রোজগার নেই এখন তাই সন্তানদের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হচ্ছে। চাকরির পেনশন সরকারের কাছে সারেন্ডার করে সমুদয় অর্থ একবারে এককালীন তুলে নিয়েছে তাই শুধু মেডিকেল সুবিধা ও বছরে উৎসব ভাতা ছাড়া আর কিছুই পায় না। সন্তানদের যার যেমন রোজগার করে তাতে তাদেরই ভরনপোষণ কষ্টসাধ্য অন্যদিকে বাবার ওষুধের খরচ অন্যান্য চাহিদাগুলো মিটাবে কীভাবে। একটা পরিবারে অভাব অনটন থাকলে যা ঘটে পিটারের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে আর প্রতিনিয়ত এই বিষয়গুলো নিয়ে সমস্যা বেড়েই চলেছে যার ফলশ্রুতিতে সন্তানদের কাছে তাদের বাবা একটা বোঝার মতো এখন। বিষয়টাকে কীভাবে গ্রহণ করব বুঝে উঠতে পারছি না তবে যেটাই হচ্ছে সেটা কখনো একটা মানুষের কাম্য নয়। সংসারে একটা লোক রোজগার করবে বলেই তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে সেটা তো হতে পারে না। একজন বাবা যখন দীর্ঘ সময় তার সন্তানদের লালন করে তখন তার ব্যায় হয় না! সন্তান বেরোজগারী বলে কী বাবা তার সন্তানদের ফেলে দেয়? বাবা-মা প্রবীণ হলে সন্তানদের এমন চিন্তা-চেতনা কেন হবে সেটাই আমার জিজ্ঞাসা। প্রশ্নটা আমার কাছে কিন্তু এর উত্তর কার কাছে খুঁজব। অনেকদিন পর হঠাৎ একদিন পিটার এসে খুব বেজায় মুখ করে বসে আছে। এই সাত সকালে এমন গোমড়ামুখি মানুষ দেখলে নিজেরই দিনটা খারাপ যায়। তখনো অনিমেষ আর সারোয়ার রাউন্ড সেরে আসেনি। আমি এক রাউন্ড শেষ করে এসে বসেছি সবে।

‘কী হে মনটা বেশ খারাপ মনে হচ্ছে। কোনো সমস্যা? থাকলে শেয়ার করতে পার। শেয়ার করলে অনেক সমস্যারই সমাধান আসে। তাছাড়া বুকের মধ্যে জমে থাকা বিষয়গুলো মাঝে মাঝে হালকা করতে হয় নতুবা এগুলো ওজন বাড়াতে থাকে।’

‘দাদা, জীবন অনেক কিছু শিখায় আর আমরা সারাজীবনই শিখে যাই। আগে ভাবতাম বুড়োদের শিখার কিছু নেই ওরা জীবনের অভিজ্ঞতায় সবকিছু শিখে ফেলে, আমি ভুল ছিলাম।’

‘মানুষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিখে এখন কী হয়েছে সেটা বল।’

‘কী আর বলব আমার বিষয়টা তো আপনাদের কাছে এখন আর অজানা নেই। পরিবারে মাঝে মাঝে নিজেকে বড় অকেজ মনে হয়, যেন আমি একটা বোঝা এই পরিবারে। তিন বেলা খেয়ে যাচ্ছি বেহায়ার মতো।’

‘ছিঃ ছিঃ এভাবে কেন ভাবছ পিটার। তুমি কী তোমার সংসারের জন্য কখনো কিছু করোনি। একটা মানুষ সারা জীবন কর্ম করতে পারে না তার অবসর আছে এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।’

‘এটা তাদেরকে বোঝাবে। আমার পেনশনটা সারেন্ডার করা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আজ যদি পেনশন থাকত তাহলে নিজের খোরাক নিজেই ব্যবস্থা করতে পারতাম। সন্তানদের উপর বোঝা হয়ে থাকতাম না। মেডিকেলের সামান্য টাকা দিয়ে আমার ডায়াবেটিকের ওষুধের খরচও অর্ধেক মাস চলে না।’

‘ঠিকই বলেছ যারা পেনশন বিক্রি করেছিল তাদের অনেকেই এখন সমস্যায় আছে। শেষ বয়সে পেনশনের এই টাকা যে কত উপকারী যার নাই সে বোঝে।’

‘বিক্রি করতাম না ভাবলাম ছেলেরা তো আর চাকরি জোগাড় করতে পারেনি তাই এককালীন টাকাটা নিয়ে কোনো ব্যবসা ধরিয়ে দিলে তাদের ভবিষ্যত গড়ে যাবে কিন্তু হয়নি। অল্প কিছুদিন ভালো চলেছিল তারপর পরিচালনার অদক্ষতায় ব্যবসায় দিল লস। টাকাগুলো হারিয়ে আমার যে কী কষ্ট হয়েছিল সেটা বলে বুঝাতে পারব না দাদা। সারাজীবনের অর্জন এক পলকেই লুটিয়ে দিল।’

‘বুঝতে পারছি তোমার সমস্যা। ভুলটা সেখানেই ছিল। একটা বিষয় মনে রেখ তোমার পরিশ্রমের অর্জন তোমার কাছে যতটা মূল্যবান সেটা তোমার সন্তানদের কাছে থাকবে না কারণ সে সেটা অর্জন করেনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। টাকাগুলো উপর্জন করে যদি ব্যবসা দিত তাহলে চেষ্টা থাকত এটা থেকে লাভ বের করা।’

আমাদের আলাপ-আলোচনার মাঝে কখন যে অনিমেষ আর সারোয়ার এসে যোগ দিল দুজনের কেহই টের পাইনি। পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে ওরা দুজনে কথাগুলো শুনেছিল। যদিও এখানে বলার মতো কিছু ছিল না। অবসরে যাওয়ার পর তখন আমরা সকলেই কমবেশি অসহায় হয়ে আছি। সারোয়ার যখন হঠাৎ বলে উঠল তখন বুঝতে পারলাম তাদের উপস্থিতি।

‘তুমি আমাদের আগে বলনি কেন এই কথাগুলো।’

‘কী হবে বলে। কোনো সমাধান তো আসবে না তাহলে বলে লাভ কী।’

পিটারের এই বাক্য আমাদের সকলকে নিশ্চুপ করে দিল। বাক্যটা যদিও কাঁটার মতো বিঁধেছিল কিন্তু বাস্তবতা নিগূঢ়। এরপর আমরা কেউ আর কিছু বলতে পারিনি। তবে সমাধানটা খোঁজার চেষ্টায় ছিলাম প্রত্যেকে নিজের মতো করে। খুঁজে পাব কীভাবে যেখানে অন্যদের জীবনের গতি ছিল লাগামহীন আর আমরা ঝিমিয়ে পড়া কয়েকটা মানুষ যার গতিশীলতার কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পাই না। কিছু বিষয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করা যায় একে অপরে দোষারোপ করা যায় কিন্তু সংশোধন নিজেকেই করতে হয় নতুবা আপনজনরা আর আপন থাকে না।

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় দেখুন]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়