প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:২৫
দৃষ্টিনন্দন প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীকক্ষ এবং ওয়েল বিইং

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘প্রাক প্রাথমিক’ শ্রেণীর শিক্ষা এমন একটি চাবিÑযা শিশুর ভবিষ্যতের দরজা খুলে দেয়। ভবিষ্যতের উন্নত নাগরিক হিসেবে এবং স্বনির্ভর পাঠক ও লেখক হতে সহায়তা করে।প্রাক প্রাথমিক শ্রেণীকে বিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বার বা ওপেনার, ক্ষেত্র বিশেষে মধ্যমণিও বলা হয়।
বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত শিশুদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এটি কেবল অক্ষরজ্ঞান বা গণিত শেখানো নয়, বরং শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগীয় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সহায়তা করে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্যসমূহ
* আনন্দময় পরিবেশ: প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো খেলাধুলা, গান, গল্প বলা, ছড়া আবৃত্তি, ছবি আঁকা এবং বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে শেখা। এটি শিশুদের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং তাদের ভীতি দূর করে।
* বয়সসীমা: সাধারণত, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ৫+ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদী হয়ে থাকে। তবে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কিন্ডারগার্টেনে ৩ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্লে-গ্রুপ, নার্সারি বা কিন্ডারগার্টেন নামে একাধিক স্তর থাকে।
* শিক্ষক ও উপকরণ: প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের শিশুদের প্রতি যত্নশীল, স্নেহময় এবং ভালোবাসাপূর্ণ হতে হয়। শ্রেণিকক্ষটি শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় ও শিশুবান্ধব করে সাজানো থাকে। বিভিন্ন খেলনা, ছবি, চার্ট, এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক উপকরণ ব্যবহার করা হয়।
* পাঠ্যক্রম: প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম শিশুর সার্বিক বিকাশের উপর জোর দেয়। এখানে বর্ণ ও সংখ্যা জ্ঞানের পাশাপাশি নৈতিকতা, স্বাস্থ্যবিধি, পরিবেশ সচেতনতা এবং সামাজিক দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা হয়।
* উন্নয়নমূলক ক্ষেত্র: প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলোতে উন্নতি সাধনে সাহায্য করে:
* শারীরিক বিকাশ: খেলাধুলা ও অঙ্গসঞ্চালনের মাধ্যমে।
* মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ: কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে।
* সামাজিক বিকাশ: সমবয়সীদের সাথে মেলামেশা ও ভাগাভাগি করার মাধ্যমে।
* আবেগীয় বিকাশ: নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে শেখার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা:
* জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০: এই নীতিমালায় ৫+ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদী প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়েছে।
* সরকারি উদ্যোগ: বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু করা হয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে।
* গুরুত্ব: প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের ঝরে পড়ার হার কমাতে, বিদ্যালয়ে তাদের উপস্থিতির হার বাড়াতে এবং প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় তাদের পারফরম্যান্স উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি শিশুদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি করে।
এছাড়াও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদেরকে (চৎব-ঢ়ৎরসধৎু ংঃঁফবহঃং) বিদ্যালয়ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এই ধারণাটির মূল ভিত্তি হলো শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য এবং শিশুর সামগ্রিক বিকাশ। কিছু প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলে এ বিষয়টি সহজ হবে।
১। শিশুর গুরুত্ব ও বিশেষ চাহিদা
প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিশুরা নতুন পরিবেশে আসে এবং তাদের যত্ন ও মনোযোগের প্রয়োজন হয়। এই বয়সে তারা বিদ্যালয়ের নিয়মকানুন, শিক্ষক ও বন্ধুদের সাথে পরিচিত হয়। তাদের বিশেষ চাহিদা পূরণের জন্য পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের দিকে মনোনিবেশ করে।
২ । বিকাশের ভিত্তি স্থাপন
এই বয়সটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগিক এবং জ্ঞানীয় বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের ভবিষ্যৎ শিক্ষার ভিত্তি গড়ে তোলে। অক্ষর জ্ঞান, সংখ্যা জ্ঞান, সৃজনশীলতা, এবং সামাজিক দক্ষতাÑসবকিছুর শুরু হয় এই স্তর থেকে। এই ভিত্তি যদি মজবুত হয়, তবে তাদের পরবর্তী শিক্ষাজীবন সহজ ও সফল হয়।
৩ । শিক্ষণ পদ্ধতির কেন্দ্রবিন্দু
প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শেখানোর পদ্ধতি শিশুদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। এখানে খেলাধুলা, গান, গল্প এবং বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে শেখানো হয়, যা শিশুদের আগ্রহ ধরে রাখতে সাহায্য করে। শিক্ষকরা শিশুর মানসিক অবস্থা, আগ্রহ এবং শেখার গতি অনুসারে পাঠদান পরিকল্পনা করেন। অর্থাৎ, পুরো শিক্ষণ প্রক্রিয়াটিই শিশু-কেন্দ্রিক (পযরষফ-পবহঃবৎবফ)।
৪। শিক্ষকের ভূমিকা
এই স্তরের শিক্ষকরা শুধু পড়ান না, বরং তারা শিশুর বন্ধু, পথপ্রদর্শক এবং তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও কাজ করেন। তারা প্রতিটি শিশুর ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেন এবং তাদের বিকাশে সাহায্য করেন। শিক্ষকের সব মনোযোগ ও প্রচেষ্টা শিশুর চাহিদা পূরণের দিকে নিবদ্ধ থাকে।
বিদ্যালয়ের প্রতিটি নীতি, কর্মসূচি এবং শিক্ষণ পদ্ধতি এই শিশুদের সর্বোত্তম বিকাশের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়।
প্রাক-প্রাথমিক শিশুদের ক্ষেত্রে ওয়েল-বিইং নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শৈশবের সুস্থতা তাদের ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে ওয়েল বিইং সম্পর্কে আমাদের সকলের সুস্পষ্ট কিছু ধারনা থাকা দরকার। ওয়েল-বিইং (ডবষষ-নবরহম) বা সুস্থতা হলো একটি সামগ্রিক ধারণা, যা শুধুমাত্র শারীরিক সুস্থতা নয়, বরং মানসিক, আবেগিক এবং সামাজিক সুস্থতার সমন্বয়। যখন একজন মানুষ সবদিক থেকে ভালো থাকে, অর্থাৎ সে শারীরিকভাবে সুস্থ, মানসিকভাবে শান্ত, আবেগিকভাবে স্থিতিশীল এবং সামাজিকভাবে সংযুক্ত, তখনই বলা যায় সে ভালো আছে।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ওয়েল-বিইং হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি তার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট, ইতিবাচক অনুভূতি অনুভব করে এবং জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা রাখে।
নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করে শিশুদের উপর ওয়েল-বিইং এর ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়:
১. শারীরিক সুস্থতা (চযুংরপধষ ডবষষ-নবরহম)
শিশুদের শারীরিক সুস্থতা তাদের মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
* খেলাধুলা ও সক্রিয়তা: প্রতিদিন পর্যাপ্ত সময় খেলাধুলা করার সুযোগ দেওয়া উচিত। দৌড়াদৌড়ি, লাফানো এবং বিভিন্ন ধরনের খেলায় অংশ নেওয়া শিশুদের পেশী ও হাড়ের বিকাশে সাহায্য করে।
* সুষম খাদ্য: তাদের প্রতিদিনের খাবারে পুষ্টিকর খাবার যেমনÑশাকসবজি, ফলমূল, দুধ ও ডিম অন্তর্ভুক্ত করা।
* স্বাস্থ্যবিধি: ছোটবেলা থেকেই শিশুদের হাত ধোয়া, দাঁত মাজা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা।
২. মানসিক ও আবেগিক সুস্থতা (গবহঃধষ ধহফ ঊসড়ঃরড়হধষ ডবষষ-নবরহম)
শিশুদের মনের যত্ন নেওয়া তাদের আত্মবিশ্বাস এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা বাড়ায়।
* নিরাপদ পরিবেশ: শিশুদের এমন একটি পরিবেশ দেওয়া যেখানে তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করে এবং কোনো ভয় ছাড়া তাদের মনের কথা বলতে পারে।
* আবেগকে বোঝা: যখন শিশুরা রাগ, ভয় বা মন খারাপের মতো আবেগ প্রকাশ করে, তখন তাদের বকা না দিয়ে বরং তাদের আবেগগুলো বোঝার চেষ্টা করুন এবং শান্তভাবে তাদের সাথে কথা বলুন।
* প্রশংসা ও উৎসাহ: তাদের ছোট ছোট কাজ ও সাফল্যের জন্য প্রশংসা করুন। এতে তারা নিজেদের মূল্যবান মনে করবে এবং নতুন কিছু করার আগ্রহ পাবে।
* সৃষ্টিশীল কাজ: আঁকা, গান গাওয়া বা গল্প বলার মতো সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করা, যা তাদের আবেগ প্রকাশের একটি সুস্থ মাধ্যম হতে পারে।
৩. সামাজিক সুস্থতা (ঝড়পরধষ ডবষষ-নবরহম)
সামাজিকভাবে সুস্থ থাকা শিশুদের অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার দক্ষতা বাড়ায়।
* অন্যের সাথে মেশা: সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা ও মিশতে উৎসাহিত করুন। এটি তাদের ভাগ করে নেওয়া, সহযোগিতা করা এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখায়।
* শিষ্টাচার শেখানো: অন্যদের সম্মান করা এবং ভদ্রভাবে কথা বলার মতো ভালো আচরণ শেখানো।
* পারিবারিক সময়: পরিবারের সাথে নিয়মিত সময় কাটানো। একসাথে খাওয়া, গল্প করা বা খেলাধুলা করা শিশুদের মধ্যে সম্পর্ককে দৃঢ় করে।
সংক্ষেপে, শিশুদের ওয়েল-বিইং নিশ্চিত করা মানে হলো তাদের এমন একটি পরিবেশ দেওয়া যেখানে তারা শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে ভালো থাকার সুযোগ পায়। এর ফলে তারা আরও সুখী, আত্মবিশ্বাসী এবং সুস্থ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে।
এছাড়াও বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ সর্বাধিক আকর্ষণীয় ও শিশুর উপযোগী করে সুজ্জিত হতে হবে। এরকম আকর্ষণীয় ও সুসজ্জিত হলে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। একটি সুন্দর ও আকর্ষণীয় পরিবেশ ছোট শিশুদের জন্য পড়ালেখাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে। এর ফলে শিশুরা স্কুলকে ভয় না পেয়ে বরং প্রতিদিন আগ্রহ নিয়ে স্কুলে আসে।
ক. শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি
একটি আকর্ষণীয় শ্রেণিকক্ষ শিশুদের মধ্যে শেখার আগ্রহ বাড়ায়। রঙিন ছবি, খেলনা, এবং বিভিন্ন শিক্ষামূলক উপকরণ তাদের কৌতূহল বাড়াতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে শিশুরা খেলাচ্ছলে অনেক কিছু শিখতে পারে।
খ. সামাজিক ও মানসিক বিকাশ
সুন্দর পরিবেশে শিশুরা একে অপরের সাথে মিশতে এবং খেলতে পছন্দ করে। এতে তাদের সামাজিক দক্ষতা বাড়ে।
গ. শ্রেণিকক্ষের আকর্ষণীয় পরিবেশ শিশুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে, যা তাদের মানসিক বিকাশের জন্য জরুরি।
ঘ. সৃজনশীলতার বিকাশ
আকর্ষণীয় শ্রেণিকক্ষ শিশুদের সৃজনশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন ধরনের রং, কাগজ, মাটি এবং অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে তারা নিজেদের কল্পনাকে প্রকাশ করতে পারে।
ঙ. শিক্ষকের জন্য সুবিধা
শিক্ষকরাও এমন পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আকর্ষণীয় উপকরণ ব্যবহার করে তারা শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন, যা পড়ানোকে আরও সহজ ও কার্যকর করে তোলে।
সব মিলিয়ে, একটি আকর্ষণীয় প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ এবং প্রাক প্রাথমিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক-যিনি সাপ্তাহিক রুটিন অনুসরণ করে এবং ওয়েল বিইং সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে আকর্ষণীয় পাঠদান করবেনÑএটা শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য একটি মজাদার এবং শেখার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে, যা তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন করে।
লেখক : ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা প্রাইমারি এডুকেশন ট্রেনিং সেন্টার (ইউপিইটিসি), হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।