প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৫, ০১:০৩
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর শিখনে ‘সেইফ স্পেস’

শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ে সবার সমান অধিকার। এক্ষেত্রে কোন ধরনের বৈষম্য করা চলবে না। বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবারের মত বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাকে অভিভাবকের ভূমিকা রোল প্লে করা লাগে। অথবা নেতিবাচক পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। কেননা এই একবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষায় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় আমরা দেখি প্রতিনিয়ত।
দূর্বল হলেই সমস্যা!
শরীর দূর্বল হলে ভেতরের ও বাইরের নানান ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে বসে।
মন দূর্বল হলে ভয় এবং হতাশা গ্রাস করে মনের প্রায় সবটুকু। তখন জীবনের অর্জনগুলো চলে যায় পর্দার আড়ালে। আর সামনে বসে নৃত্য করে, ভেঙচি কাটে ও ফণা তোলে যতসব অর্থক এবং অনর্থক ব্যর্থতাগুলো। আস্ত এক সফল জীবন পাওয়ার পরও তখন মনে হয়, জীবনের সবটাই যেন বাজে খরচ হয়ে গেলো।
ব্যক্তির গণ্ডি পার হয়ে এবার এই দূর্বলতার ছবিটা একটু বড় ক্যানভাসে দেখি চলুন।
সমাজ দূর্বল হলে তার নিজের শিল্প-সংস্কৃতি, জীবনবোধ, মূল্যবোধে ভাটা পড়ে। তখন বাইরের স্রোত এসে সেই শূন্যস্থান পূরণ করে। বাইরের স্রোতকে সবসময়ই নিজের শিল্প-সংস্কৃতি, জীবনবোধ, মূল্যবোধের ছাকনি দিয়ে ছেকে নিতে হয়। নইলে সেখান থেকে সামান্য মণি-মুক্তা যা থাকে তা খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং স্রোতের সাথে এসে জমা হয় অজস্র ক্ষতিকর শ্যাওলা ও কচুরিপানা। সমাজে স্বল্প মেয়াদে ব্যাধি এবং দীর্ঘ মেয়াদে কর্কট রোগ সৃষ্টির জন্য এরাই যথেষ্ট হয় তখন।
আর রাষ্ট্র দূর্বল হলেও ঐ একই ঘটনা ঘটে। আড়ালে থাকা ভেতরের ও বাইরের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াগুলো তখন সামনে এসে নৃত্য করে, ভেঙচি কাটে ও ফণা তোলে। যদি বাঁচতে হয়, তাহলে ছোবল মারার আগেই অ্যান্টি-ভাইরাস ও অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়ার ডোজ প্রয়োগ করা চাই।
আসুন, সুস্থ শরীর ও মন নিয়ে বাঁচি। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবার বেলাতেই তা সত্যি।
বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘সেইফ স্পেস’: এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম এবং সেখানে একটি বিশেষ কক্ষ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কক্ষটিতে একটি শোবার খাট ও একটি ফার্স্ট এইড বক্স রয়েছে। জানতে পারলাম, এটি আসলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা একটি ‘সেইফ স্পেস’ বা নিরাপদ আশ্রয়। বয়োসন্ধিকালে মেয়েদের নানা শারীরিক পরিবর্তন ও জটিলতা দেখা দেয়।বিশেষ করে প্রথমদিকে তারা বেশ সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই সময়ে একজন শিক্ষিকার (মহিলা শিক্ষিকা) তত্ত্বাবধানে যেন তারা বিশ্রাম নিতে পারে বা প্রয়োজনীয় পরামর্শ পেতে পারে। সেই উদ্দেশ্যেই এই কক্ষটি তৈরি করা হয়েছে।এই উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের সংবেদনশীলতা এবং দায়িত্ববোধের এক দারুণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন একটি ‘সেইফ স্পেস’ তৈরি করার ধারণাটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা (ওহপষঁংরাব ঊফঁপধঃরড়হ) ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা বলতে বোঝায় এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা
যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী, সে যেই হোক না কেন, তার নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। শারীরিক, মানসিক বা সামাজিক যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা যেন শিক্ষার্থীর শেখার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করাই অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার মূল লক্ষ্য।মেয়ে শিক্ষার্থীদের বয়োসন্ধিকালীন শারীরিক পরিবর্তনগুলো তাদের শিক্ষাজীবনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অস্বস্তি, ব্যথা বা মানসিক দ্বিধার কারণে অনেক সময় তারা স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে পারে বা পড়াশোনায় মনোযোগ হারাতে পারে। একটি নিরাপদ এবং সহায়ক পরিবেশ না পেলে এই সমস্যাগুলো আরও প্রকট হতে পারে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থায় সমান তালে এগিয়ে নেয়ার জন্য তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এক্ষেত্রে সেইফ স্পেসের কথা আমরা পরিকল্পনা রাখতে পারি।
এই ‘সেইফ স্পেস’ কক্ষটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বাড়ির পরিবেশ তৈরি করে। এর ফলে:
শারীরিক স্বস্তি: যখন কোনো শিক্ষার্থীর পিরিয়ডজনিত সমস্যা বা অন্য কোনো শারীরিক অস্বস্তি হয়, তখন তারা এখানে বিশ্রাম নিতে পারে। ফার্স্ট এইড বক্সের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসাও পাওয়া সম্ভব।
মানসিক স্বস্তি ও নিরাপত্তা: বয়োসন্ধিকালীন পরিবর্তনগুলো অনেক মেয়ের জন্যই নতুন এবং বিভ্রান্তিকর হতে পারে। একজন শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে তারা নির্দ্বিধায় নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারবে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে পারবে। এটি তাদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে এবং স্কুলে তাদের নিরাপত্তা বোধ বাড়াবে।
শিক্ষায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ: এই ধরনের সহায়তা পাওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে উৎসাহিত হবে। শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কারণে তাদের অনুপস্থিতি কমে আসবে। যা তাদের শিক্ষায় প্রবেশাধিকার (ধপপবংং) নিশ্চিত করবে এবং ঝরে পড়ার হার কমাবে।
সামাজিক ট্যাবু ভাঙা: ঋতুস্রাব বা বয়োসন্ধিকালীন বিষয়গুলো সমাজে অনেক সময় ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। বিদ্যালয়ে এই ধরনের একটি কক্ষ থাকার অর্থ হলো, এই বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এবং সচেতনতা তৈরি যা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করবে।
ভবিষ্যতের জন্য একটি আদর্শ মডেল:
এই উদ্যোগটি বাংলাদেশের অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জন্যও একটি অনুকরণীয় মডেল হতে পারে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি ‘সেইফ স্পেস’ তৈরি করা গেলে তা তাদের শিক্ষাজীবনকে আরও মসৃণ ও ফলপ্রসূ করে তুলবে। এটি কেবল মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাই নয়, বরং তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং শিক্ষায় পূর্ণ অংশগ্রহণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উল্লেখ্য, দৃশ্যতঃ উপরের বর্ণনা মোতাবেক শুধু মেয়েদের বয়োসন্ধিজনিত সমস্যায় নয়,অন্য কোন কারণে ছেলে/মেয়ে উভয়ের যে কোন শারীরিক/মানসিক বিশ্রামে ‘সেইফ স্পেস’ ব্যবহৃত হয়।এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, একটি বিদ্যালয় যখন তার শিক্ষার্থীদের চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব দেয় এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করে, তখনই তা প্রকৃত অর্থেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
লেখক : ইনস্ট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।