প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৫, ০১:০১
ডিজিটাল ভূত

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অনেক দিন পর স্কুলে এলো অনিক। মাঝে দু-তিন বছর গ্যাপ হলেও তাকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়েছে। অনিকের বাবা হাতেম আলী বিদেশ থেকে এসে সবকিছু জেনে তাকে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন।
অনিক ইংরেজির ক্লাস করছে। শিক্ষক সবুজ সমশের ইংরেজির গ্রামার পড়াচ্ছেন। ক্লাসে শিক্ষার্থী ছেলেমেয়ে প্রায় একশ’জনের মতো হবে।
এ সময় পেছন থেকে মোনালিসা নামের একটি মেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো : স্যার ভূত, স্যার ভূত।
এ সময় শিক্ষার্থীদের মাঝে এ ভূত-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লম্বা কালো কেউ ধাক্কা দিয়েছে, কেউ বলে লাল ভয়ানক কেউ এসেছে, কেউবা বলে, হাত ধরে টান মেরেছে। এসব বলে শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা বিদ্যালয়ে ছুটে আসে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাফী বিন কবির খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়ে ছুটে আসেন এবং এ বিষয়ে খোঁজখবর নেন। এই ঘটনা তদন্তের জন্যে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
তিনি শিক্ষার্থীদের অভয় দিয়ে বলেন : প্রচণ্ড গরমের কারণ এমন হতে পারে। তবে ঘাবড়ানোর মতো তেমন বিষয় না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাহাবুব হোসেন বলেন : হঠাৎ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চিৎকার চেঁচামেচি করলে শিক্ষকরা সবাই বিষয়টি জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। জানতে পারি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন ভয় পেয়ে চিৎকার দিলে পাশের সবাই চিৎকার দেয় ছোটাছুটি করে নিচে নেমে আসে। তবে বিদ্যালয়ে কোনো ভূতপ্রেত নেই। এমন ঘটনা এই প্রথম হয়েছে।
সবাই যার যার কথায় ব্যস্ত। এ সময় অনিক দেখলো তার সামনে দাঁড়ানো রয়েছে কবিরাজ। সে বললো : অনিক তুমি ভয় পাওনি?
অনিক : না, আমি ভয় পাই না।
কবিরাজ : ভয় পাওয়া বীরের কাজ না। ভালো কথা। তোমার তো আমার সাথে দেখা করার কথা ছিলো। তোমাকে নিয়ে আমি আরও কাজ করতে চাই, অনেক বড় বড় কাজ। তুমি যাবে না আমার সাথে?
এ সময় অনিক তার মাথায় কিছু একটা অনুভব করলো। তারপর সে মোহগ্রস্তের মতো হয়ে পড়লো। এবার কবিরাজ বললো : আসো অনিক, আমরা এবার চট্টগ্রামের গভীর জঙ্গলে চলে যাবো, সেখানে কেউ আমাদের পাত্তাই পাবে না। গাড়িতে জামশেদ, স্বপ্নীল ও তাসনীম আছে। সবাই মিলে পিকনিক করতে যাবো।
ক্লাসের কেউ কবিরাজকে দেখলো না। শুধু অনিক তার পিছু পিছু ক্লাস থেকে বেরিয়ে কবিরাজের সাথে চলে গেলো।
বাইরেই একটি গাড়িতে জামশেদসহ অন্যরা বসেছিলো। কবিরাজ অনিককে নিয়ে গাড়িতে উঠতেই জামশেদ গাড়ি চালাতে শুরু করে।
রাত তিনটায় এসে তারা চট্টগ্রামের দুমলং পর্বতশৃঙ্গে উপস্থিত হয়। এটাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বলে দাবি করা হয়। পাহাড়টি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। এ পর্বতের উচ্চতা ৩,৩১৪ ফুট। এটি রাঙ্গামাটি জেলার সর্বোচ্চ পর্বত ও দেশের ১০০০ মিটারের অধিক উচ্চতার ৩টি পর্বতের মধ্যে একটি।
এই পর্বতের পাদদেশে একটি ঘর আছে। সেই ঘরে এসে ওরা প্রবেশ করলো। কবিরাজের এক শিষ্য হেকমত শাহ এখানে থাকে। এলাকার মানুষকে যাদুটোনা করা সহ বিভিন্ন কেরামতি দেখিয়ে অর্থ কামাই করে। তার গুরু আসবে জেনে সে আগে থেকেই সব রেডি করে রেখেছে।
কবিরাজ আসা মাত্রই তাকে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো। এ সময় কবিরাজ বলে উঠলো : কিরে হেকমত সব ঠিকঠাক আছে তো?
হেকমত : হ, হুজুর। সব ঠিক আছে। এখানে আমাগোরে কেউ ট্র্যাক করতে পারবো না। এখানে কোনো নেটওয়ার্ক নাই।
কবিরাজ : মারহাবা মারহাবা। তোমার মাথায় ঘিলু বেশ শক্তিশালী। যাই হোক, অনেক পরিশ্রম করে আসছি, খেতে দে।
খেতে বসে কবিরাজ বললো : শোন হেকমত, এই এলাকায় আমরা আমাদের জ্বিনভূতের রাজত্ব শুরু করবো। তার সাথে সব ধরনের ধান্ধাবাজির কাজ, ইয়াবা ব্যবসার কাজ, অস্ত্রশস্ত্র বিক্রয়ের কাজ শুরু করবো। তুই আবার ভয় পাবি না তো?
হেকমত : এটা তো জলবৎ তরলং হুজুর। আপনের এই পর্যন্ত কেউ ধান্ধাবাজির ব্যবসায় ধরতে পারছে? ভবিষ্যতেও পারবো না। আপনি হলেন জ্বিনের বাদশা, ভূতের বাদশা। আপনের কথায় সব নাচে, কান্দে- গড়াগড়ি খায়। আমরা তো আপনের চাকর মাত্র। শুধু হুকুম করবেন, কাজ হয়ে যাবে।
কবিরাজ : সাব্বাশ হেকমত। তোর মতোই শিষ্য আমার দরকার। তুই আর জামশেদ সমান ভাগ পাবি সব কাজের।
হেকমত : ঠিক আছে হুজুর। এখন কি করতে অইবো তা বলেন।
এই বাচ্ছা তিনটারে ঘুমানোর ব্যবস্থা কর। এদের দিয়েই আমি অনেক কাজ করিয়ে নিবো। এরা এখন আমার অনুগত। আমি যা বলবো, এরা এখন তাই করবো।
অনিকের মা সুমি বেগম আবারও হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছেন। স্কুল থেকে নাকি অনিক ফিরে আসেনি। তার কান্নায় অনিকের বাবা হাতেম আলী, মামা সুজন দৌড়ে এলেন।
সুজন : কী হয়েছে আপা, তুমি আবার কাঁদছো কেন?
সুমি বেগম হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে যা বললেন, তার সারমর্ম এই : অনিকের স্কুলে ভূতের আতঙ্কে ২০ জন ছাত্র-ছাত্রী বেহুঁশ হয়ে পড়েছে, এই সুযোগে অনিক কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না।
অনিকের বাবা ও মামা কথাটা শুনে হতভম্ভ হয়ে থানায় ছুঁটলেন।
ওসি ইরফান সাহেবকে বেশ চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে। তিনি তাদের সব কথা শুনে মাথায় চিন্তা ভাঁজ ফেলে দিলেন। তারপর এএসআই করিম বখতকে ডাকলেন। করিম বখত আসতেই হুংকার দিলেন : স্কুলে এতো সব ঘটনা ঘটে গেলো আমাকে জানালেন না কেন?
করিম বখত : স্যার, আমি তো আসামী নিয়া কোর্টে গিয়েছিলাম। তাই আপনাকে বিষয়টা জানাতে পারি না।
ওসি : তাহলে থানার বাকি সব মরে গেছে কিনা চেক করো। তারা আমাকে বিষয়টা জানালো না কেন?
করিম বখত কাছুমাছু হয়ে চুপ দাঁড়িয়ে থাকলো
ওসি ধমকে উঠলেন : আরে সাপের মতো মোড়ামোড়ি করলে হবে না তো, ওদের ২টি বাচ্ছা আজ কতদিন যাবত নিখোঁজ, অনিকরে আমরা উদ্ধার করেছিলাম, তারপর সেও এখন নিখোঁজ। নাকে সর্ষের তেল দিয়া ঘুমালে আমাগো চাকরি থাকবো? এদেরকে উদ্ধার করার সব রাস্তা বাইর করো। মানইজ্জত আর কিছুই রইলো না। থানায় একশ’ পুলিশ থাকতে সবার নাকের ডগার উপর দিয়ে ছেলেটারে তুইল্যা নিয়া গেলো তোমরা কেউ আঁচই করতে পারলা না!
ওসির মেজাজ গরম। কোনোরকমে লম্বা লম্বা পা পেলে নিজের ডেস্কে গিয়ে কাজ শুরু করলো করিম বখত। সুনন্দাকে ফোন দিলো, এক্ষুণি অফিসে হাজির হও। অপারেশন থ্রি চাইল্ড শুরু হচ্ছে।
‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ বাংলা প্রবাদের মূল্য আছে। অফিসাররা যতোই হম্বিতম্বি করুক না কেনো তারা তিনমাসেও তিনটি শিশুকে উদ্ধার করতে পারলো না।
এদিকে এই তিন মাসে পাহাড়ের মধ্যে কবিরাজ তার সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এতোদিনে কবিরাজের দলবল বেড়েছে, পুরো পাহাড়ে তার রাজত্ব চলছে। ইয়াবার ব্যবসা, অস্ত্র চালান করে কবিরাজ ও তার দুই শিষ্য জামশেদ ও হেকমত এখন বহু টাকার মালিক। শহরে যেতে তারা দামী গাড়ি ব্যবহার করে। খাওয়া দাওয়া রাজকীয়। অনিক, তাসনীম, স্বপ্নীলকে তার ইয়াবা আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহার করে। শিশু মনে করে তাদেরকে বাইরের কেউ সন্দেহ করে না। এই সুযোগ কবিরাজ তাদেরকে দিয়ে সব অপকর্ম করিয়ে নিচ্ছে।
তবে কথায় আছে, অন্যায় হলো আগুন। আগুন কখনো চাপা থাকেনা। সব অন্যায়েরই একদিন বিচার হয়, দেরিতে হলেও ধরা পড়ে অপরাধী।
কবিরাজ ও তার শিষ্যদের পাপের পাল্লা ভারী হচ্ছে।
ওসি তার সব প্রচেষ্টা প্রয়োগ করলেন। জেলার সব স্থানেই সোর্স নিয়োগ করলেন। প্রায় ছয় মাস পর তিনি খবর পেলেন দুমলং পাহাড়ে এক কবিরাজের আস্তানা আছে। সেখানে দুটি শিশু আর এক কিশোরও আছে। তার সাথে দু’জন শিষ্য থাকে। তারা সব ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
ওসি আর দেরি করলেন না। তিনটি গাড়িতে প্রয়োজনীয় পুলিশ বাহিনী নিয়ে রাত তিনটায় অপারেশন ‘থ্রি চাইল্ড’ শুরু করলেন।
এবার আর কোনো ফাঁকিবাজি চললো না। একে একে ধরা পড়লো কবিরাজ, জামশেদ, হেকমত। আর উদ্ধার হলো অনিক, স্বপ্নীল ও তাসনীম। ওদেরকে পেয়ে ওদের পরিবার মহাখুশি। বোরহান সাহেব তো ওসির দক্ষতায় পঞ্চমুখ। তিনি বললেন : ওসি সায়েব আপনাকে অভিনন্দন।
ওসি : সায়েব না, সায়েব না। ভাই বলুন। পুলিশ জনগণের বন্ধু, অপরাধীদের শত্রু। দেখলেন তো ক্যামনে রাঘববোয়ালগুলা ধরা পড়লো। ওই দেখেন তাগোরে লকারে ঢুকায়া রাখছি। রাতে খানাপিনা শেষে আগামীকাল কোর্টে চালান দেওয়া হবে।
সুজন : খানাপিনা মানে?
ওসি : বুঝলেন না? এতোদিন আমাগোরে কষ্ট দিছে না। মাইনকা চিপায় ফালাইছে না? এই একটু আধটু হাল্কা নাচানো-কুদানো হবে পুরো অপকর্ম-অপরাধের কথা বাইর করতে। এমনে তো আর তাগো অপরাধ স্বীকার করবো না। খাওন লাগবো হাল্কা-পাতলা।
ওসির কথায় রুমা বেগম, সুমি বেগম, বোরহান সাহেব, হাতেম আলী ও সুজন হেসে উঠলো। তারপর তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আসার সময় পাশের লকারে দেখলো এএসআই করিম বখত কবিরাজ, জামশেদ, হেকমতকে আচ্ছা তরফে ধোলাই করছে। আর তাদের চিৎকারে পুরো থানা কাঁপছে।