প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৫, ০৯:২৯
তোরে খুব মনে পড়ে মা

মা রে, তুই কেমন আছস্? জানি, চাইলেও ভালো থাকার অভিনয় করিস, কিন্তু তোর মুখের ভিতরের কষ্ট আমার মন বুঝে ফেলে মা। আমি ঠিক তোর সেই একলা উঠোনটার মতন, যেইখানে আগে প্রতিদিন বিকালে তুই একটা কাঠের পিঁড়িতে বসে আমাকে গরম ভাঁপ ওঠা মুড়ি খাওয়াইতি। মনে আছে? এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখিÑতুই থালায় মুড়ি, নারকেল, সর্ষের তেল মিশাইয়া বলিস, এই নে খা, তোরা শহরের মানুষ তো আর এইগুলা খাস না।
মা, এই শহরের ইট-কাঠ-লোহার ভিড়ে আমি হারাইয়া গেছি। বড় বড় দালান কোঠার নিচে দাঁড়ায়া তোর ছোট্ট কাঁচা রান্নাঘরটার কথা মনে পড়ে, যেইখানে তুই হাত-পা মুড়িয়ে লাকড়ির চুলায় রান্ধিস আর আমি পিছনে দাঁড়ায়া লুকাইয়া এক চামচ খাইয়া ফেলি! তুই পিঠে টোকা মেরে হাসতিস-আহারে, বড় মানুষ হইছিস, তাও ভাত রান্ধা না হইতেই খাইস!
মা, স্কুলে যাওয়ার সময় সকালে যেই পাট বাঁন্ধা গামছা দিয়ে আমার মাথায় হাত রাখতি, এই শহরে কেউ তা করে না মা। এখানে সবাই নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত, কেউ কারো দিকে চায় না। তোর সেই ‘যত কষ্টই হোক, হাসি মুখে থাকিস, বলা কথাটা আজ মনে হইলে চোখে পানি আইসে’।
তুই কি এখনও সন্ধ্যা বেলা উঠোনে দাঁড়াইয়া আমার পথ চাস্ মা? এখনও কি তোর চোখে আমার জন্য কান্না থামে না? আমি জানি, তোকে কিছু বলি না ঠিকই, কিন্তু প্রতিদিন তোর মুখখানার ছবি আমার ফোনে খুঁজি।
মা, খুব দেখতে ইচ্ছে করে তোর সেই মায়া ভরা চওড়া হাসিটা, সেই গরম ভাতের গন্ধ, উঠোনের গরুর ডাক, আর সন্ধ্যায় কাঁসার থালায় তুলা দেওয়া ধূপের গন্ধ!
এই চিঠির মাঝেই আমার শ্বাসের গন্ধ, চোখের জল আর তোর প্রতি অসম্পূর্ণ বলা ভালোবাসা।
মারে সত্যি করে বল্ তো, তোর ঘাড়ের ব্যথা কি এখনও হয়? তোর ওই পুরোনো ব্যথাটার কথা প্রতিদিন চিন্তা করি। আমি জানি, তুই কিছু বলবি না, শুধু বলবি, ভালো আছি মা, তোরা চিন্তা করিস না। কিন্তু আমি জানি মা, তুই ভালো থাকলেও তোকে ঘিরে আমার ভিতরে এক অজানা শূন্যতা সবসময় বাজে।
তোরে বলা হয় না, কিন্তু শহরের এই ইট-কাঠের ভিড়ে, গ্লাস-চিপা অফিসঘরে বসে, কতবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুধু তোর মুখটাই খুঁজি। মনে হয়, হঠাৎ করেই একদিন দেখি, তুই বারান্দায় দাঁড়াইয়া ডাকতাছস এই শোন, ভাত খাইছিস?
মা, মনে আছে তোর সেই কাঁচা উঠোনটা? বিকাল বেলা তুই যখন কাঁথা ছড়ায়া বসতিস, পিঠে করে কলা পাতায় মুড়ে মুড়ি-চানাচুর দিতিস, আমি তখন মাঠ থেকে বল খেলায় ফিরি আর তুই বলতি
কত খেলবি আর? আয়, একটু খা। এখন আর কেউ সেইভাবে ডাকে না মা, কেউ বলেও না, তোর শরীর ঠিক আছে তো?
তুই কি এখনও সন্ধ্যার সময় উঠোনে ধূপ জ্বালাস মা? সেই ধোঁয়ার গন্ধটা আমার এখনো নাকে লেগে থাকে। বুকে মোচড় দেয়, জানিস? আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখি তুই সাদা শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়া ধূপ জ্বালাস, আর দূরে কোনো এক মসজিদে আজানের সুর ভেসে আসে। সেইসব সন্ধ্যা, সেইসব উঠোন আর সেই তুই সব এখন শুধু স্মৃতি।
এই শহরে অনেক কিছু আছে মা, বড় বড় দালান, দামি খাবার, চকমকে জীবন। কিন্তু এখানে তোর মত একটা মানুষও নেই। যে শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নেয়, খাইছি কিনা, মন ভালো কিনা, বা কষ্ট পাইছি কিনা।
মনে পড়ে মা, আমি যখন জ্বর নিয়ে পড়েছিলাম, তুই সারারাত জেগে আমার কপালে পানি দিস, হাতে গরম করে তেল মালিশ করতিস। এখন জ্বর এলে শুধু ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকি, কেউ নেই মাথায় হাত রাখার। বুকটা কেমন জানি ফাঁকা লাগে।
মা, তুই কি মনে রাখছিস, আমি কীভাবে ছোটবেলায় ভয়ে তোর আঁচল ধরে রাখতাম? তখন ভাবতাম, তুই থাকলে আমি কখনো হারবো না। আজ তুই কাছে নেই, তাই বুঝি এই জগত বড় নিষ্ঠুর, মা।
তোর সেই কাপড় পরা, খোলা চুলে ভোরবেলা পুকুরঘাটে যাওয়া, নারকেল ভাঙার শব্দ, ধান ভানার গানÑএসব আমি এখন স্বপ্নে শুনি। শহরের মানুষরা জানেই না, ‘ঘরের মায়া’ কাকে বলে। ওদের জীবন শুধু সময়ের দাস।
তোর রান্না করা সেই ইলিশ মাছ, ভাজা বেগুন, ডালের গন্ধ এখনো নাকে লেগে থাকে। এখানকার হোটেলের দামি খাবারে ঐ মায়া পাই না মা।
মা রে, তুই জানিস? তোকে ছাড়া আমি আসলে কিছুই না।
তোর কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর সেই শান্তিটুকুই আজ জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া হয়ে গেছে।
আমি যতই দূরে থাকি, তুই আমার শিকড় মা, তুই আমার আশ্রয়, আমার নির্ভরতা। তুই দোয়া কর মা, যেন একদিন আবার তোর কোলে ফিরে আসতে পারি। যেন আবার উঠোনে তোর সাথে বসে গরম মুড়ি খেতে পারি, আর চোখে চোখ রেখে বলিÑ
তুই আছিস বলেই আজো আমি বেঁচে আছি।
তুই শুধু আমার জন্য দোয়া করিস। জানিস তো, তোর দোয়াই আমার পৃথিবীর সব থেকে বড় আশীর্বাদ।
ইতি
ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায় ভরা,
তোর সেই ছোট্ট সোনা ছেলে
আবির।