রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৫, ০৯:২৮

যে চিঠি পাওনি তুমি

এ এম সাদ্দাম হোসেন
যে চিঠি পাওনি তুমি

প্রিয় সিরতাজ, মগডালের সেই কচি পাতাটা সুকিয়ে আজ জরাজীর্ণ। যেকোনো সময়-ই সে আলতো হাওয়ার আঘাতে খসে পড়বে মাটিতে। এটি বিধির বিধান, প্রকৃতির নিয়ম। পথচারির পদঘাতে শুকনো পাতা সুর তুলবে, কান পেতে হয়তো কেউ সেই সুর উপলব্ধি করবে ক্ষণেক্ষণ। সুরের মোহনায় সবাইকে ভাসিয়ে সেও একদিন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে; তার খেলা-ই বা ক’জনে রাখবে?

সিরতাজ, স্বচক্ষে কখনো কি রংধনু দেখেছো? দিগন্তের এপাশ থেকে ওপাশ দৃষ্টিনন্দন আভা ছড়ানো রংধনুর সাত রং বিধির ইচ্ছায় সেজেছে জ্যামিতিক সাজে। আবালবৃদ্ধবনিতার দল সেই মাহেন্দ্রক্ষণে অনেকটা নির্বাক হয়ে যায়। হয়তো- তারাও সেই মুহূর্তে ভেসে যেতে চায় সবচে’ কাছের মানুষটির স্মৃতির জোয়ার-ভাটায়।

সিরু, তুমি আমার জীবনে এসেছিলে আকস্মিক দমকা হাওয়ার ন্যায়! মানুষ যেমন বাতাসকে দেখতে পায় না, কিন্তু অনুমান করে বলতে পারে- ‘বাতাস বইছে’। তুমি ঠিক তেমনি আমার হৃদয়ের শূন্যস্থান পূরণ করলে। তুমি তো অদৃশ্য! তোমার আর বাতাসের মধ্যে তপাৎ কী?

প্রিয় বাতাসিনী, তোমার অদৃশ্য অস্তিত্বের ভাণ্ডার থেকে বিন্দু বিন্দু সুখ চুরি করে স্বপ্নের জাল বুনেছি হৃদয়ের মাজারে। সাজিয়েছি বাসর; যেমনি হয়তো ইতিরাও সাজিয়েছিলো। আমরাও একদিন গত হবো। নতুন কুড়ি আমার হাল ধরবে; যে প্রথা অব্যাহত থাকবে কাল থেকে মহাকাল পর্যন্ত। জীবনটা সত্যিই বৈচিত্রময়। কল্পনার ওপর ভর করে হাঁটি হাঁটি পা-পা মেলে এগিয়ে যেতে থাকি তোমার স্বশরীরিক দোরগোড়ার খোঁজে। হাতে থাকে এক জোড়া পদ্ম কিংবা কচুরি’র ফুল। মূল্যহীন এই পচনশীল বস্তুটিই তোমার জন্য সবচে দামি উপহার হিসেবে মনে হয়েছে আমার কাছে। যার একটিতে থাকবে ভালোবাসার নিমন্ত্রণ আর অন্যটিতে থাকবে শুভ পরিণয়ের আমন্ত্রণ। নিজ হাতে তোমার খোঁপায় গেঁথে দিতে পারলেই যেনো আমার পুরুশ্বত্যের জন্ম স্বার্থক হবে; আমি তৃপ্ত হবো। সত্যিকারের প্রেমিকের এর চেয়ে আর বেশি কী-ই-বা আশা থাকতে পারে?

প্রিয় অদৃশিনী, স্বপ্নেরঘোরে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর আগেই আমার জীবনে ঘটে গেলো স্মরণকালের এক মহাপ্রলয়! যাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আমার পরিবার। সেই প্রলয়ের আঘাতে আমার পরিবারের ৩ সদস্য (বাবা-মা-আমি) ছিটকে পড়ি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। কী অদ্ভূত কাণ্ড! তাই না? বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান বিধায় তাদেরও আমায় নিয়ে আশা-আকাক্সক্ষার কোনো কমতি ছিলো না। কিন্তু ফল কী হলো দেখো, আমার জন্যই তাদের আসতে হলো ইহকালের জাহান্নামে! তাঁদের সমস্ত স্বাদআহ্লাদ আমি এভাবে পূরণ করবো- কল্পনাও করিনি কখনো।

বাতাসিনী, লোকে বলে আমার কবর নাকি আমি নিজেই খুঁড়েছি। তাই তো মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড বেশি অসহায় লাগে। ভাবছো- মৃত্যু ভয়ে? জন্ম যখন নিয়েছি, মরতে একদিন হবেই; মিছেমিছি আর ভয় পেয়ে লাভ কী, তাই না?

সিরতাজ, ভাগ্য আমার সাথে চরম প্রতারণা করেছে দেখো। আমার কপালটাই না এ রকম। যে অদৃৃশ্য ধ্বনিতে আমি মাতোয়ারা হয়েছিলাম, সুখটুকুও কেড়ে নেয়ায় বিধাতার প্রতি অনেক অভিমান হয়েছিলো। অদৃশ্য বার্তাটুকুও অদৃশ্য হয়ে গেলো জীবন থেকে। কিন্তু হাল ছাড়লাম না। প্রার্থনা করতে থাকলাম- তোমার অস্তিত্ব ফিরে পাওয়ার।

সিরু, ইট, সিমেন্ট আর লৌহায় ঘেরা এ জগৎটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করলে একবিন্দুও ভুল হবে না। কতো কিছুই না শিক্ষার ব্যবস্থা করে গেছে ব্রিটিশওয়ালারা। আমি-ই বা তার থেকে বাদ যাই কেমন করে বলো।

জলের মাছ ডাঙায় উঠলে ছটপট করতে থাকে নিজপ্রাণ বাঁচাতে। সে ভাবে- এই বুঝি জমদূত চেপে ধরলো। সেই মুহূর্তে কী তার সঙ্গীর কথা মনে পড়ে? কেন-ই বা পড়বে না। তারো তো প্রাণ আছে, মাংস আছে, আছে রক্ত, বিবেকবুদ্ধিরও কমতি নেই। বিপদে পড়লেই মানুষের ফেলে আসা সোনালী দিনের কথা বারবার মনে পড়তে থাকে। কূলহীন মাঝ দরিয়ায় ভাসতে ভাসতে আমারও মনে পড়ে সেদিনের কথা। দুমড়ে-মুছড়ে যায় বুকের ভেতরখানি। অদৃশ্য শক্তির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় মনপ্রাণ। চুয়ে চুয়ে পড়ে আমার স্বপ্ন খুনের রক্ত। স্মৃতিশক্তি কিছুক্ষণের জন্য কোথায় যেনো ওধাও হয়ে যায়। যন্ত্রণার অনলে জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয় আমার ভেতর বাড়ি। যন্ত্রণাকে হত্যা করবো ভেবে শক্ত হাতে নিজের গলা নিজেই চেপে ধরি; এই বুঝি সবশেষ! সিরতাজ, আমার স্বপ্নের হাতে থাকা সেই পদ্ম-কচুরি ফুল দু’টো ক্রমেই শুকিয়ে যেতে থাকে। মনের আকাশটাও যেনো পড়ন্ত বিকেল হারিয়ে ফেলেছে। ঘোরআমবশ্যা অপেক্ষা করছে তার জন্য। তারপরই হয়তো কালের স্রোতে ভেসে যাবে সে। তারপরেও মুখ ফসকে বিদ্রোহের স্বরে চিৎকার করে বলিÑআমি অদৃশিনীর দোরগোড়ায় পৌঁছতে চাই।

ইতি তোমার স্বপ্নের অদৃশ্য পুরুষ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়