প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫, ১০:৪৯
কেন ফিরছেন না তারেক রহমান?

প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা স্বৈরাচারী সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিদায় নেওয়ার আট মাস পেরিয়ে গেলেও দেশে ফেরেননি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান। চার মাস আগে চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যখন লন্ডন যাচ্ছিলেন, তখন নেতা-কর্মীরা মনে করছিলেন, সঙ্গে পুত্র তারেক রহমানকে নিয়ে দেশে ফিরবেন। কিন্তু বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ৬ মে তার দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমান ফেরার ফিরলেও তারেক রহমান ফিরেন নি। কেন আসছেন না সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের মনে। তিনি এতদিনেও দেশে না ফেরায় জনমনে বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—এটা কি শুধু আইনি জটিলতা নাকি রাজনৈতিক কোনো বোঝাপড়ার বিষয়। তবে আইনি জটিলতা ছাড়া বাকি বিষয়গুলো উড়িয়ে দিয়েছেন বিএনপির নেতারা। বিএনপি নেতাদের বক্তব্য
বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, তারেক রহমান সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই দেশে ফিরবেন। মামলা সংক্রান্ত যেসব আইনি জটিলতা আছে সেগুলো কেটে গেলে তিনি মাতৃভূমিতে পদার্পণ করবেন। তারেক রহমানের আইনজীবীও আইনের শাসনেই ভরসা রাখছেন।
বিএনপি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল উল্লেখ করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আইনের শাসন ব্যতীত গণতন্ত্র চলবে না। তারেক রহমান চাচ্ছেন আইনি প্রক্রিয়ায় (ডিউ প্রসেস অফ ল’) শেষ করতে। আইনের শাসনের মাধ্যমে সেটা করতে হবে। শেখ হাসিনার মতো একটা অর্ডার দিয়ে আপনি সব মামলা বাতিল করে দিলে তো হবে না। ওইটা আইনের শাসনের আওতায় আসে না। এটা করলে জনগণের আস্থা থাকবে না, আইনের শাসনও ফিরে আসবে না। আইনের শাসন ব্যতীত গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। উনি এসব মামলা সুষ্ঠুভাবে মোকাবেলা করেই দেশে ফিরবেন, শিগগিরই ফিরবেন। ’
অপরদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদের আশা, ‘তারেক রহমানও খুব শিগগিরই দেশে আসবেন’।
তারেক রহমানের অপেক্ষায় আছেন জানিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি বলেন, ‘তারেক রহমান খুব শিগগিরই আসবেন। আইনি যে জটিলতা ওনার জন্য রয়েছে, সে জটিলতা আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এখনো কিছু মামলার রেজাল্ট পেন্ডিং (অপেক্ষমান)। দেশে এবং দেশের বাইরে লন্ডনেও। সবকিছু মিলিয়ে উনি শিগগিরই আমাদের মাঝে আসবেন, আমরা তার অপেক্ষায় আছি।’
তারেক রহমান সব সাজা থেকে খালাস পেলেও একটি মামলায় তার দণ্ড রয়ে গেছে। মামলাটি আলোচিত ‘ওয়ান-ইলেভেন’ খ্যাত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান এবং শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে করেছিলেন দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক জহিরুল হুদা। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট এ মামলায় তারেক রহমানকে ৯ বছর এবং তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আবেদনের প্রেক্ষিতে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে ডা. জুবাইদা রহমানের দণ্ডাদেশ এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ও তারেক রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘আমরা সব সময় যে কথা বলে আসছি, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং ডা. জুবাইদা রহমান ম্যাডামসহ যারা আছেন, প্রত্যেকটা মামলায় জিয়া পরিবার আইনের শাসনের প্রতি বিশ্বাসী। দেশের প্রচলিত সংবিধানের প্রতি বিশ্বাসী এবং আদালতের প্রতি আস্থাশীল। ওনাদের মামলাগুলো ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে নিষ্পত্তি হবে। ’তারেক রহমানের গ্রেপ্তার ও বিদেশ যাত্রা
আলোচিত ‘ওয়ান-ইলেভেন’ খ্যাত ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশব্যাপী কথিত অভিযানে নামে। সেনাসমর্থিত ওই সরকারের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ব্যবসায়ীদের আটক করা হয়। ওই বছরের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান।
২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন তিনি। লন্ডনযাত্রার কয়েক ঘণ্টা আগে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তারেক রহমান।
২০০৮ সালের ঢাকায় সেদিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন জেমস এফ মরিয়ার্টি। ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে তিনি সেসময় গোপন তারবার্তা পাঠিয়েছেলেন। সেগুলোর সবকিছু উইকিলিকস সাইটে ফাঁস হয়। ওই তারবার্তার একটিতে মরিয়ার্টি লিখেছিলেন, ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ছিলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা-ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন উচ্চপদস্থা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এটিএম আমিন। ৩ সেপ্টেম্বর মরিয়ার্টি ওয়াশিংটনে সে তারাবার্তা পাঠান বলে সেখানে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মরিয়ার্টি জানান, ওই বৈঠকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্রি. আমিনের আলোচনা হয়, যেখানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মুক্তি ও মুক্তির পর তারেক রহমানকে চিকিৎসার জন্যে বিদেশে পাঠানোর আলাপ উঠে। এছাড়া রাজনীতি থেকে তারেক রহমানের ‘কিছু সময়ের জন্য বিরতিতে’ যাওয়ার কথাটিও তখন আলোচিত হয়।
বিবিসি বাংলার অনলাইন ভার্সনের ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তার ‘কারাগারে কেমন ছিলাম (২০০৭-২০০৮)’ বইতে লিখেছেন, ‘এমনও হতে পারে তিনি (খালেদা জিয়া) জেনারেলদের সঙ্গে এই সমঝোতা করেছিলেন যে, তারেক রহমান আপাতত নিজেকে রাজনীতিতে জড়াবেন না এবং এ মর্মে তারেক রহমান কোনো সম্মতিপত্রে স্বাক্ষরও দিয়ে থাকতে পারেন। ’ তারেক রহমান লন্ডন যাত্রার আগে তাঁর মা খালেদা জিয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে, সুস্থ না হয়ে উঠা পর্যন্ত তারেক রহমান রাজনীতির বাইরে থাকবেন। ”
দীর্ঘ আট মাসেও দেশে না ফেরায় পুরোনো সেসব বিষয় নিয়েই আলোচনা তৈরি হয়েছে। যাদিও সেনা সমর্থিত সেই সরকারের কোনো অবস্থা নেই বাংলাদেশে। তবে কি শুধু নৈতিক অবস্থান থেকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, নাকি মামলা থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি না পেয়ে দেশে ফিরবেন না এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তৃণমূল বিএনপির সমর্থক আব্দুর রহিম। তিনি মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হলে তারেক রহমানকে দেশে আসতে হবে। নইলে নির্বাচন সুদূর পরাহত হয়ে যাবে।মামলা বিএনপির এই শীর্ষ নেতা দেশ ছাড়ার এক বছর আগে তথা ২০০৭ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত ৮০টির বেশি মামলার মুখে পড়েন। কয়েকটি মামলায় তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে সাজাও দেওয়া হয়। সাজার রায় দেওয়া বেশির ভাগ বিচারক ‘পুরস্কারস্বরূপ’ পদোন্নতিও পেয়েছিলেন বলে মনে করেন বিএনপির নেতারা। গত ৫ আগস্ট পট পরিবর্তন হলে সিংহভাগ মামলাও নিষ্পত্তি হয়ে যায়। তবে কয়েকটি মামলা এখনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।
খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রা
ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও বিভিন্ন মামলার মুখে পড়েন। এমনকি দুই মামলায় দণ্ডিত হয়ে জেলও খেটেছিলেন। পরে ২০২০ সালের করোনার সময়ে আইন অনুসারে সরকার তাকে মুক্তি দেয়। সেই থেকে গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’য় ছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু কারাবন্দি থাকার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। অনেক চেষ্টা করেও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারেননি। চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নিতে পরামর্শ দিলেও তৎকালীন আদালত ও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি দুই মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন। কিন্তু খালেদা জিয়া আইনগত প্রক্রিয়ায় হাঁটেন। আইনিভাবে আপিল শুনানি শেষে তিনি সর্বোচ্চ আদালত থেকে খালাস পান।
এরপর গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। লন্ডন ক্লিনিকে ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়া তারেক রহমানের বাসায় উঠেন। ক্লিনিকটির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে দীর্ঘদিন পর পরিবারের সঙ্গে ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করেন বিএনপির চেয়ারপারসন।দেশে ফিরেছেন খালেদা জিয়া
শনিবার (৩ মে) সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক যৌথ সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ম্যাডাম খালেদা জিয়া লন্ডনে চার মাস চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রথমে যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় ধারাবাহিকভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। প্রতিদিন তার অবস্থা উন্নতি হয়েছে। একদিকে একটি ভালো পরিবেশ, বিশেষ করে পারিবারিক পরিবেশ, একইসঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে উন্নত চিকিৎসার কারণে তিনি আল্লাহর অশেষ রহমতে আগের চাইতে অনেক সুস্থ বোধ করছেন। সে কারণে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশে ফিরে আসবেন।
তিনি বলেন, আমরা আশা করেছি বেগম খালেদা জিয়া একটি বিশেষ বিমানে, আমরা যেটা আশা করছিলাম যে বিমানে তিনি গেছেন, অর্থাৎ কাতারের রয়েল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশে ফিরে আসবেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জানিয়েছেন, ৬ মে খালেদা জিয়া দেশে ফিরেছেন।
[প্রতিবেদনটি যৌথভাবে তৈরি করেছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ইলিয়াস সরকার, সিফাত বিনতে ওয়াহিদ ও সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট তানভীর আহমেদ]
সূত্র : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম।