প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:১০
জনপ্রিয় ইংরেজি শিক্ষক সৈকত অধিকারী হারিয়ে গেলেন নীরবে

বহুগুণের অধিকারী একজন নীরব বিনয়ী মানুষ নীরবেই হারিয়ে গেলেন। তিনি চাঁদপুরের একজন জনপ্রিয় ইংরেজি শিক্ষক সৈকত অধিকারী। বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সন্ধ্যা সাতটায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি পরলোকগমন করেন। এর আগে তিনি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ করছিলেন। পরে অবস্থা জটিল হওয়ায় তাঁকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনতিবিলম্বে ঢাকায় রেফার করেন। সৈকত অধিকারীর বাবা নারায়ণ অধিকারী একজন ক্যান্সার আক্রান্ত দীর্ঘদিনের শয্যাশায়ী রোগী। তাঁর মা রিতা অধিকারীও দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে চিকিৎসাধীন থেকে মৃত্যুবরণ করেন। সৈকত অধিকারী চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে দীর্ঘদিন চাঁদপুর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ইংরেজি ভার্সনে শিক্ষকতা করেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তিনি এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে মৈশাদী উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি যেমন মেধাবী ছিলেন, তেমনি অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন। ‘নির্ঘুম মিশ্র’ ছদ্মনামে তিনি কবিতা লিখতেন। আবৃত্তি চর্চাও করতেন। তিনি বৃটিশ কাউন্সিলের অধীনে আইইএলটিএস ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষক ও পরীক্ষক ছিলেন। তিনি চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির ইংরেজি বিতর্ক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমেরও শিক্ষক ছিলেন। তিনি চাঁদপুর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে থাকাকালীন তাঁর মেন্টরশিপে এ স্কুলের বিতর্ক দল পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দুবার (একবার বাংলা ও একবার ইংরেজিতে) জেলাব্যাপী চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। সৈকত অধিকারী চাঁদপুর জেলার ‘বেল্টা’ (বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন) সংগঠনের একজন উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সৈকত অধিকারী তাঁর একমাত্র বোন তটিনী অধিকারীকে অতিক্রান্ত ঘোষালের সাথে বিয়ে দিয়ে সুপাত্রস্থ করে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত ছিলেন এবং মৃত্যুকালীন তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩১ বছর (জন্ম তারিখ ০১.০১.১৯৯৪)। তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্র-ছাত্রী ও সহকর্মী আছেন, যারা এই অমায়িক ও নিরীহ মানুষের অকাল মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে গেছেন। শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সকালে চাঁদপুর মহাশ্মশানে ধর্মীয় বিধানমতে তাঁর মরদেহের সৎকার সম্পন্ন হয়। চাঁদপুরে ইংরেজি শিক্ষকদের অনেকেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে কিংবদন্তিতুল্য ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় হয়েছেন। এঁদের মধ্যে চাঁদপুর সরকারি কলেজের ইংরেজির শিক্ষক এবিএম ওয়ালি উল্লাহর নাম উল্লেখ করা যায়। তাঁকে তাঁর ভক্ত শিক্ষার্থীরা ‘টাইগার অব চাঁদপুর কলেজ’ হিসেবে অভিহিত করতেন। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকুরি পাওয়ার পরও সে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতা পেশাতেই ফিরে আসেন। তাঁর মৃত্যুতে চাঁদপুরে সর্বদলীয় নাগরিক শোকসভা হয়েছে, যেটা তাঁর চেয়ে বহুল পরিচিত ব্যক্তির কপালেও জোটেনি। ইংরেজি শিক্ষক ত্রিশোর্ধ্ব বয়সী সৈকত অধিকারী খ্যাতির চূড়ায় ওঠার আগেই অকাল মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নীরবে হারিয়ে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে বোঝা গেছে, তিনি ছিলেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়। ধর্মের বিভেদকে ভুলে শ্মশান অভিমুখে তাঁর মরদেহকে ঘিরে যে শব মিছিল দেখা গেছে, অঝোর কান্নায় আত্মীয় তো বটেই, অনাত্মীয়দেরও যেভাবে অশ্রুপাত করতে দেখা গেছে, শ্মশানে যে ভিড় দেখা গেছে, তাতে আন্দাজ করা যায়, বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো একদিন ওয়ালি উল্লাহ স্যারের মতোই সর্বজনশ্রদ্ধেয় হয়ে যেতেন। করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর ডেঙ্গু-চিকনগুনিয়ার কাছে তিনি হার মেনে মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে অসহায় অবস্থায় রেখে যেভাবে চলে গেলেন, তাঁর ভক্ত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সেটি মেনে নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে এ কষ্টকে সমর্পণ করতেই হচ্ছে, যেহেতু স্রষ্টা জন্মক্রম ঠিক রাখলেও মৃত্যুক্রম ঠিক রাখেননি। আমরা কষ্ট বুকে চেপেই সৈকত অধিকারীর অকাল প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করছি। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সৈকত অধিকারীর মতো আর যেনো কারো এভাবে অকাল মৃত্যু না হয়-মহান স্রষ্টার কাছে নিরন্তর সে আকুল প্রার্থনা জানাচ্ছি।