বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:২৩

বাংলা নাটকে প্রবীণ

হাসান আলী
বাংলা নাটকে প্রবীণ

বাংলা নাটকে প্রবীণ চরিত্র কখনো পরিবার প্রধান, কখনো অবহেলিত আবার কখনো অভিজ্ঞতার প্রতীক হয়ে আসে। প্রথাগত সমাজ থেকে আধুনিক সমাজে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ চরিত্রের চিত্রণও বদলে গেছে। একদিকে প্রবীণের দুঃখ-কষ্ট, অবহেলা, অপমান, নির্যাতন-নিপীড়ন, নিঃসঙ্গতা-একাকীত্ব যেমন উঠে আসে, অন্যদিকে প্রবীণের শৌর্য বীর্য, জ্ঞান গরিমা, দক্ষতা অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়।

নিচে কয়েকটি বাংলা নাটকের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ পাঠকের জন্যে দেওয়া হয়েছে।

১. কবর--মুনীর চৌধুরী।

কবর নাটকে প্রবীণদের বীরোচিত, চিন্তাশীল ও আত্মত্যাগীরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যে অনন্য এক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই চরিত্র আমাদের শেখায় প্রবীণরা কেবল অতীতের স্মারক নয়, বরং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক।

২. সারি তিন একান্ন-- সেলিম আল দীন।

একটি প্রতীকধর্মী নাটক, যেখানে পরিবার, সমাজ ও মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব তুলে ধরা হয়েছে। নাটকে প্রবীণ চরিত্র হিসেবে উঠে আসে। পরিবারের কর্তা একজন বৃদ্ধ পিতা, যিনি ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের ধারক এবং পারিবারিক কাঠামোর স্তম্ভ। নাটকে তাঁর নির্দিষ্ট নাম কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাঁর অবস্থান ও প্রভাব অনেক গভীর। বৃদ্ধ পিতা পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তিনি সব কিছু জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেন। তাঁর উপস্থিতি পরিবারকে বেঁধে রাখে। এই প্রবীণ চরিত্র অনেক সময় নিজের কষ্ট, অপমান গোপন রেখে পরিবারের শান্তি রক্ষার চেষ্টা করেন। তাঁর নীরবতা কখনো কখনো প্রতিবাদের রূপ নেয়, যেটা দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগায়। যুব প্রজন্মের সাথে মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও তিনি তাদের ভালোবাসেন ও বোঝার চেষ্টা করেন। এই পারস্পরিক সম্পর্ক নাটকের মানবিক গভীরতা বাড়ায়।

৩. নূরুলদীনের সারাজীবন--সৈয়দ শামসুল হক।

নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নূরুলদীন ঊনিশ শতকের একজন বৃদ্ধ কৃষক নেতা, যিনি ইংরেজ শাসন ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। নাটকে তাঁকে কেবল ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে নয়, বরং প্রতিরোধের প্রতীক, প্রবীণ নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

নূরুলদীন প্রবীণ বয়সেও নির্ভীক। তিনি অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখান। তিনি নিজের জীবনের নিরাপত্তা ত্যাগ করে জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াই করেন। নাটকে প্রবীণ বয়সে নূরুলদীনের যন্ত্রণা, শারীরিক কষ্ট, তবুও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আত্মত্যাগী প্রবীণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

৪. এইসব দিন রাত্রি-- হুমায়ুন আহমেদ।

‘এইসব দিন রাত্রি’ নাটকে দাদু চরিত্রটি প্রবীণদের এমন একরূপ উপস্থাপন করে, যেখানে তাঁরা কেবল অসহায় বৃদ্ধ নন, বরং পরিবারের আবেগ, অভিজ্ঞতা ও জীবনের সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দু।

হুমায়ুন আহমেদ অত্যন্ত স্নেহ-মমতার সঙ্গে এই চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন। এই নাটক আমাদের শেখায়, বার্ধক্য মানে শেষ নয়, বরং পরিবারে প্রবীণদের উপস্থিতি এক অমূল্য সম্পদ।

৫. গহর বাদশা ও বানেস্বরে--সেলিম আল দীন।

গহর বাদশা ও বানেস্বরে নাটকে প্রবীণ পীর-দরবেশ আধ্যাত্মিক চরিত্রেরা কোনো সরল মানুষ নন, তাঁরা জীবন দর্শনের প্রতীক। প্রবীণরা নীতির প্রবক্তা এবং চরিত্র বিকাশের দিশারী। নাট্যকার তাঁদের ব্যবহার করেছেন গভীর প্রতীকমূলক নাট্য কৌশলের অংশ হিসেবে। এটি বাংলা নাটকে প্রবীণ চরিত্রদের জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা এবং সাংস্কৃতিক প্রজ্ঞার প্রতিনিধিত্বের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।

৬. দেয়াল--হুমায়ুন আহমেদ।

দেয়াল নাটকে প্রবীণ চরিত্ররা সরাসরি নায়ক নন, কিন্তু পুরো জাতির বিবেক, ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ তাঁদের মাধ্যমে উঠে আসে। তাঁদের দ্বিধা, সিদ্ধান্ত ও অবস্থান নাটকের অভ্যন্তরীণ চাপ ও টানাপোড়েনকে বাস্তবিক এবং আবেগঘন করে তোলে।

৭. পথিক--মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।

নাটকের শিরোনাম চরিত্র ‘পথিক ‘একজন প্রবীণ অভিজ্ঞ ও দার্শনিক স্বভাবের ব্যক্তি, যিনি এক প্রতীকী যাত্রায় রয়েছেন। তাঁর যাত্রা কেবল স্থান পরিবর্তনের নয়, বরং জীবনের গভীর অর্থ অন্বেষণের প্রতীক। পথিকের মনে বারবার উঠে আসে জীবনের শূন্যতা, সম্পর্কের ভাঙ্গন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। এই একাকীত্ব নাটকে প্রবীণদের বাস্তব অবস্থা এবং মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। পথিক প্রবীণ বলেই সমাজ ও মানুষের রূপান্তরের সরাসরি সাক্ষী। তিনি তরুণদের চেয়ে বেশি জানেন, কিন্তু সেই জ্ঞান তাঁকে শান্তি দেয় না বরং প্রশ্ন জাগায়, ব্যথিত করে।

মমতাজ উদ্দিনের এই চরিত্রের মাধ্যমে প্রবীণদের জীবনের অন্তিম দিকের বেদনা ও উপলব্ধিকে শৈল্পিক গভীরতায় প্রকাশ করেছেন। এই নাটক বাংলা নাট্য সাহিত্যে প্রবীণ চরিত্রকে এক গভীর, মর্মস্পর্শী ও দার্শনিক মাত্রা দিয়েছে।

৮. ছায়ানট--সেলিম আল দীন।

এক সময়ের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আজ উপেক্ষিত প্রবীণ। এই প্রবীণ চরিত্র একজন অভিজ্ঞ অভিনেতা, যিনি এক সময় ছিলেন মঞ্চের প্রাণ কিন্তু আজ নতুন প্রজন্ম, নতুন আবেগ ও সমাজের অবমূল্যায়নের কারণে তিনি ম্লান এবং ছায়ার মতো। এটি সমাজের প্রবীণদের অবস্থানকে সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করে। প্রবীণ অভিনেতা মঞ্চে থাকলেও কেউ তাঁর দিকে ফিরেও তাকায়নি। তাঁর অভিমান, ক্ষোভ, বিষণ্নতা নাটকের এক গভীর স্তর তৈরি করে। ‘আমার নাম? কেউ কি মনে রাখে?’ এই সংলাপে ফুটে উঠে এক প্রবীণ শিল্পীর নিঃসঙ্গতা ও বিস্মৃতির ভয়।

৯. কপাল কুন্ডলা-- মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

এখানে প্রবীণ সন্ন্যাসী চরিত্র উপস্থাপিত হয়েছে অভিজ্ঞতা ও দীক্ষার প্রতীক হিসেবে। তিনি যুবক-যুবতীদের ভাগ্য নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করেন। প্রবীণকে এখানে ধর্ম ও নিয়তির প্রতীক হিসেবে দেখা যায়।

১০. কুঁচ বরণী-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্রবীণ চরিত্ররা এখানে পারিবারিকভাবে কর্তৃত্বশালীভাবে অবস্থানে। তাঁরা সমাজের প্রথাগত ধ্যানধারণা বজায় রাখতে চান। তরুণ তরুণীদের স্বাধীনতা বনাম প্রবীণদের শাসন-- এই সংঘাত নাটকের মূল সুর।

১১. তিন কন্যা--সত্যজিৎ রায় (সামান্য রূপকথা অংশে প্রবীণ চরিত্র)

এখানে প্রবীণ চরিত্ররা সামাজিক অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার, কিন্তু একই সাথে বাধা ও শাসনকারী। তাঁরা তরুণদের দমন করতে গিয়ে প্রজন্মের ফাঁক স্পষ্ট করেন।

১২. অবসর--হুমায়ুন আহমেদ (টেলিভিশন নাটক)

নাটকে প্রবীণ চরিত্র হলো একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। জীবনের একাকীত্ব, অবহেলা ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়ার কষ্ট ফুটে উঠেছে। নাটকে দেখানো হয়, কীভাবে প্রবীণরা সমাজ ও পরিবারের কাছে অদৃশ্য হয়ে যায়।

১৩. নীল দর্পণ--দীনবন্ধু মিত্র।

নাটকে প্রবীণ কৃষক নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রবীণরা নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রতীক।

১৪. মুকুট--মামুনুর রশীদ।

নাটকের চরিত্র প্রবীণ কৃষক মাটির টান ও সংগ্রামের প্রতীক। প্রবীণ চরিত্র জাতির আত্ম পরিচয়ের ধারক।

১৫. শকুন্তলা--দীনবন্ধু মিত্র।

প্রবীণ ঋষি, দার্শনিক ও উপদেশদাতা।

প্রবীণরা জ্ঞান ও নিয়তির প্রতীক।

১৬. দ্বিতীয় জন্ম--সেলিম আল দীন।

এই নাটকে প্রবীণ চরিত্ররা মূলত সমাজ সংস্কৃতির ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার বাহক। তারা নতুন প্রজন্মেকে অতীতের গল্প শোনায়, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, নতুন যুগে তাঁদের আর তেমন প্রয়োজন নেই। প্রবীণদেরকে এখানে অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধন হিসেবে দেখানো হলেও প্রজন্মগত পরিবর্তনে তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে।

১৭. পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়--সেলিম আল দীন।

প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা চরিত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় মর্যাদার স্থান অধিকার করেন।

১৮. দেওয়ান গাজীর কিসসা--সেলিম আল দীন।

প্রবীণ দেওয়ান গাজী শাসক চরিত্র হলেও নাটকে শক্তি, অভিজ্ঞতা ও মর্যাদার প্রতীক।

১৯.পুতুল খেলা--মান্নান হীরা। (ইবসেন অনুবাদ)

নাটকে প্রবীণ চরিত্ররা সামাজিক দায়বদ্ধতা ও অভিজ্ঞতার মর্যাদায় উজ্জ্বল।

২০. কুঞ্জুস--মান্নান হীরা। (মলিয়ের রূপান্তর)

এই নাটকটি বাংলাদেশে সর্বাধিক মঞ্চায়ন হয়েছে।

এখানে প্রবীণ চরিত্রকে হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রবীণকে কুঞ্জুস হিসেবে দেখানো প্রবীণ মর্যাদার সাথে যায় না।

লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়