রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৭

প্রিয়জনের চিঠি

মো. তাইয়্যেব হোসাইন
প্রিয়জনের চিঠি

শহরটা বদলায়নি খুব একটা। রাস্তার মোড়ের সেই পুরনো চায়ের দোকান, লাইব্রেরির ধুলো জমা জানালা, অথবা পার্কের কোণায় পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো সবকিছু যেন ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। শুধু বদলে গেছে কিছু মানুষের স্থান, কিছু সম্পর্কের সংজ্ঞা, আর অদৃশ্য কিছু গল্প, যেগুলো এখন আর কেউ উচ্চারণ করে না। ঠিক যেমন রাহাতের গল্পটা।

অনেক বছর পর, একদিন ডাকপিয়নের হাত ধরে ফিরে আসে একখানা চিঠি। পুরোনো কালি, চেনা হস্তাক্ষর, পরিচিত ঠিকানা। খামের উপরে নামটা লেখা “রাহাত”। অথচ এই নামটি বহুদিন কেউ উচ্চারণ করেনি। বাড়িটার দরজায় এখন ধুলো জমে থাকে, জানালার কাচে ঠেকে রোদের দাগ, আর ভেতরে জমে থাকে নিস্তব্ধতা। এখানে কেউ আর থাকে না। অথচ চিঠিটা ঠিক ঠিক এসে পৌঁছেছে।

চিঠিটি পাঠিয়েছে সেই মানুষটি, যে একসময় রাহাতের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। একসময় যাকে ভালোবেসে নিজের সমস্তটা উজাড় করে দিয়েছিল সে। কিন্তু সময়ের এক কঠিন বাঁকে, ভুল বোঝাবুঝি, অব্যক্ত অভিমান আর অপার প্রত্যাশা রাহাত ও তার ভালোবাসার মাঝে গভীর এক প্রাচীর তৈরি করেছিল। কোনো ঝগড়া নয়, কোনো শেষ বিদায় নয়Ñশুধু এক নীরব বিচ্ছেদ।

এরপর বহু বছর কেটে গেছে। শহর অনেকটাই আগের মতো রয়ে গেলেও রাহাত পাল্টে গেছে। তার চলার গতি কমে গেছে, মুখের হাসিটা নিঃশব্দে মিলিয়ে গেছে। সে এখন কারও কাছে নেই। কারও বাড়ি, কারও বন্ধুর ঠিকানায় নেই। সে নিখোঁজ। আত্মগোপনে। নিজের শহরেই অচেনা এক ছায়া হয়ে থাকে সে।

কিন্তু চিঠিগুলো আসা বন্ধ হয়নি। প্রথম দিকে প্রতি মাসে একটি করে চিঠি আসত। পরে ধীরে ধীরে তিন মাস, ছয় মাস পর পর। আর এখন বছরে একবার। প্রতিটি চিঠির খামে লেখা থাকে একটি ছোট বাক্য “রাহাত, তুমি যেখানেই থাকো, আমি অপেক্ষা করছি।”

ডাকপিয়ন প্রতিদিন আসে, সুনির্দিষ্ট সময়েই। বুড়ো ডাকপিয়ন জানে, এই চিঠি কেউ খোলে না, কেউ নেয় না। তারপরও সে অপেক্ষা করে। হয়তো আজ দরজা খুলবে, কেউ চিঠিটা হাতে নেবে। কিন্তু প্রতিবারই সে ব্যর্থ হয়। শেষে খামের ওপরে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে, জানালার নিচে রেখে দেয়। আর চুপ করে চলে যায়।

সেই জানালার নিচে এখন বেশ কিছু চিঠি জমে উঠেছে। রোদে-মেঘে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া খামগুলো যেন নিজের এক একটা গল্প ধারণ করে আছে। হয়তো কোনোটার ভেতর লেখা আছে ক্ষমা চাওয়ার কথা, কোনোটাতে পুরোনো দিনের স্মৃতি, আবার কোনো একটায় হয়তো লেখা আছে, “তুমি ফিরো।”

রাহাত ফিরে আসে শহরে, কিন্তু কারও চোখে ধরা দেয় না। মাঝেমধ্যে দূর থেকে নিজের বাড়িটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাতের অন্ধকারে, বাড়ির পুরনো লাইটগুলো দেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কিন্তু পা এগোয় না। চিঠিগুলো ছুঁয়ে দেখার সাহস হয়নি এখনও। হয়তো ভয়, হয়তো অপরাধবোধ, হয়তো পুরোনো আবেগের ভার।

তার প্রিয় মানুষটি হয়তো জানালার পাশে বসে থেকেছে কতদিন, চিঠির জবাবের অপেক্ষায়। হয়তো একদিন জেনেছে, রাহাত আর চিঠি পড়তে আসে না। তবু সে লিখেছে। ভালোবাসা তো এমনই নির্বাক, একতরফা হলেও তা তীব্র হতে পারে।

রাহাতের জীবনে কেউ আর প্রবেশ করেনি। সে নিজেকে শাস্তি দিয়েছে প্রতিনিয়ত, তার মুখোমুখি না হওয়ার জন্য। যে একটিবার বলে উঠতে পারেনি, “আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমিও কষ্ট পেয়েছি। আমিও চেয়েছি ফিরে আসতে।” সেই না-বলা শব্দগুলোই তাকে গ্রাস করে রেখেছে।

এদিকে শহরের বাতাসে এখনও সেই ভালোবাসার গন্ধ। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টগুলো রাত হলে যেভাবে আলো ছড়ায়, ঠিক তেমনই কিছু কিছু অনুভূতি হৃদয়ে আলো ফেলে, নরম কুয়াশার মতো। কোনো এক রাতের হাওয়ায়, রাহাত হঠাৎ বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়ায়। জানালার নিচে পা বাড়িয়ে চিঠিগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। হাতে তুলে নেয় একখানা খাম। ধীরে ধীরে খাম ছিঁড়ে পড়ে চিঠি :

“রাহাত,

আমি জানি তুমি আসবে না। তবু আমি লিখি। লিখে স্বস্তি পাই। প্রতিবার চিঠি পাঠিয়ে ভাবি, হয়তো এবার তুমি হাতে নেবে। হয়তো এবার তুমি উত্তর দেবে। জানো, এই শহর আমার কাছে আর শহর নেই। এটি এক অপেক্ষার নাম। তুমি না এলে সবকিছু বৃথা মনে হয়।

ভালোবাসা কখনও শেষ হয় না, রাহাত। শুধু রূপ বদলায়। আমি এখন ভালোবাসি তোমার অনুপস্থিতিকে। ভালোবাসি সেই প্রতীক্ষাকে, যেটা তুমি রেখে গেছো। জানালার নিচে রেখে যাই কিছু কথা তুমি পড়ে নিও, যদি একদিন ফিরে আসো।

আমি”

চিঠি পড়ে রাহাত যেন কেঁপে ওঠে। চোখের কোণে জমে ওঠা কুয়াশা সে মুছে ফেলে না। শুধু চুপ করে জানালার নিচে বসে পড়ে। সেই বাড়ির দেয়াল ছুঁয়ে দেয় হাত, জানালার গ্লাসে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে। সময় থমকে যায়।

সেই মুহূর্তে শহরটা যেন আবার নতুন করে নিঃশ্বাস নেয়। বাতাসে আবার জেগে ওঠে এক চিরন্তন ভালোবাসা। জানালার নিচে পড়ে থাকা চিঠিগুলোর পাতায় শব্দেরা নড়েচড়ে ওঠে। আর রাহাত ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।

হয়তো এবার সে চিঠির উত্তর লিখবে। হয়তো সে ফিরবে সেই ভালোবাসার ঠিকানায়, যেখানে অপেক্ষা এখনও জীবন্ত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়