শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে কচুক্ষেত থেকে কিশোরের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৩৪

ভালোবাসা অন্তহীন

উজ্জ্বল হোসাইন
ভালোবাসা অন্তহীন

রাত গভীর। জানালার কাচে টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের ভেতর একটা হলুদ আলো নিঃশব্দে জ্বলছে। বিছানার একপাশে শুয়ে আছে বৃদ্ধ অরুণ চৌধুরী। পাশে একটি চেয়ারে বসে নিঃশব্দে কাঁদছে তার স্ত্রী মিনু। মিনু কবিতা আবৃত্তি করছে। স্কুল শিক্ষক অরুণ প্রথমবার তাকে দেখে মুগ্ধ হয়। দুই চোখের ভাষা প্রথমবার কথা বলে।

স্কুল শেষে প্রতিদিন আমগাছতলায় অরুণ দাঁড়িয়ে থাকেন। মিনুর চোখে প্রশ্ন, কিন্তু জবাব আসে নিরব ভাষায়। অরুণ ও মিনু পালিয়ে গিয়ে শহরে ছোট্ট একটি বাসায় ওঠে। শুরু হয় ভালোবাসার ওপর দাঁড়ানো সংগ্রামী জীবন।

অরুণ লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম গল্প পত্রিকায় ছাপে। মিনু ঘরে ঘরে টিউশন করেও স্বপ্ন আঁকেন। ডাক্তারের াবৎফরপঃ-তাদের সন্তান হবে না। দুঃখ কাটিয়ে মিনু ও অরুণ পথশিশুদের আশ্রয় দেয়ার আশ্রম গড়ে তোলে।

তাদের সৃষ্ট ‘ভালোবাসা অন্তহীন’ আশ্রমে শতাধিক শিশু মানুষ হয়েছে। তারা হয়েছে মা-বাবা। ভালোবাসা পরিণত হয়েছে অনন্ত দায়িত্বে।

অরুণ অসুস্থ। মিনু পাশে বসে হাত ধরে রাখে। ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা-

‘ভালোবাসা অন্তহীন, যতদিন তুমি পাশে থাকবে।’

এই ঘরেই তাদের কত হাসি-কান্না, ভালোবাসা-ভ্রান্তি, আশা-নিরাশার গল্প জমে আছে। অরুণ আজ কথা বলে না, শুধু চোখ দুটো মাঝে মাঝে একটু করে নড়ে। চোখে জমে থাকা সেই চেনা আলোটা যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে।

মিনুর চোখে ভাসে পুরোনো দিনগুলোর ছায়া

১৯৭২ সাল। দেশ ক’দিন আগে স্বাধীন হয়েছে। গ্রামের স্কুলে নতুন শিক্ষক হয়ে এসেছে সদ্য স্নাতক পাস করা অরুণ। মিনু তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। চোখে ছিল আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন। বাল্যবিয়ে থেকে বাঁচাতে তার বাবা তাকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। মেয়েটি মেধাবী ও সাহসী।

একদিন স্কুল মাঠে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করছিলো মিনু

আমার মাটির ঘরে রোদ আসে, বৃষ্টি আসে,

তবু মন চায় এক চিলতে ভালোবাসা...

অরুণের চোখ আটকে গেল মিনুর কণ্ঠে। কিছুদিন যেতেই প্রথমে পরিচয়, কথাবার্তা। শিক্ষক-ছাত্রীর ব্যবধান পেরিয়ে একটা নিষ্পাপ মুগ্ধতায় প্রেম জমে উঠল।

পরবর্তী কয়েক মাসে দুইজনের মধ্যে এক অদ্ভুত বোঝাপড়া তৈরি হলো। কখনও কেউ কিছু বলেনি, তবু প্রতিদিন স্কুল শেষে আমগাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকত অরুণ, দূর থেকে তাকিয়ে থাকত মিনু।

একদিন সাহস করে বলেছিল

আপনার চোখে আমি কিছু দেখি, যা অন্য কেউ দেখে না। আপনি কি জানেন?

অরুণ হেসে বলেছিল,

তুমি চোখ দিয়ে নয়, মন দিয়ে দেখো।

ভালোবাসা সহজ ছিল না। অরুণের পরিবার চেয়েছিল, সে শহরে ফিরে গিয়ে বড় চাকরি করুক। মিনুর পরিবার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছিল এক ধনী গার্মেন্টস মালিকের ছেলের সঙ্গে।

এক রাতে অরুণ ও মিনু পালিয়ে গেল। শহরের এক ছোট ভাড়া বাসায় নতুন জীবন শুরু করল। ছিল না টাকা, ছিল না নিশ্চয়তা শুধু ছিল দুজনার অন্তহীন ভালোবাসা।

প্রথম পাঁচ বছর তাদের দু’জনের সংসার ছিলো দুর্ভিক্ষের মতো। অরুণ একটি প্রাইভেট কলেজে পড়াত, মিনু টিউশনি করত।

এক সন্ধ্যায় মিনু বলেছিল,

তুমি চাকরি ছাড়ো, গল্প লেখো। তোমার হাতে ভাষা আছে, হৃদয় আছে। যে হৃদয়ে কথামালায় আমাকে মুগ্ধ করেছিলে। সেই মুগ্ধতা যেনো ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

সেই শুরু। অরুণের প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত এক পত্রিকায়। ধীরে ধীরে তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন লেখক হিসেবে। তাদের সংসারও দাঁড়িয়ে গেল। ছাদে টবে টমেটো গাছ, ঘরে ছোট্ট একটি বইয়ের তাক তারা গড়ে তুলল এক ছোটো স্বপ্নের জগত।

এভাবে কেটে গেলো দশ বছর। দশ বছর পরে তারা জানতে পারলো, তারা কখনও সন্তান পাবেন না। ডাক্তার জানিয়েছিলেন, মিনুর জরায়ুতে জটিল সমস্যা রয়েছে।

মিনু গভীর রাত পর্যন্ত চুপচাপ থাকত। অরুণ এক রাতে তার কাঁধে হাত রেখে বলেছিল,

তোমাকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। সন্তান না হলে কী হয়েছে? তুমি তো আমার জীবন।

সেই রাতেই মিনু প্রথমবার চোখ ভিজিয়ে বলেছিল,

তোমার ভালোবাসার কাছে আমি চিরঋণী।

তারা ঠিক করল, তারা পথশিশুদের জন্যে কিছু করবে। তারাই হবে তাদের সন্তান। নিজেদের বাড়ির একপাশে ছোট ঘর বানিয়ে শুরু করল “ভালোবাসা অন্তহীন” নামে একটি আশ্রয় কেন্দ্র। প্রথমে ৫টি শিশু, পরে ২০, পরে ৪০ এভাবে বাড়তে থাকলো। তাদের সময়, ভালোবাসা, বই আর খাবারে আশ্রয় পায় বহু অনাথ।

মিনু তাদের সবার ‘মা’ হয়ে ওঠে। অরুণ হয়ে ওঠে ‘আব্বু’।

সন্তান না থাকলেও তারা শত সন্তানের আশ্রয় হয়ে উঠল।

সময়ে আবর্তে অরুণের দৃষ্টি ঝাপসা হতে লাগল। ধরা পড়ল পার্কিনসন্স। হাত কাঁপে, কথা জড়িয়ে যায়। তিনি আর লিখতে পারেন না।

মিনু তখনও সকালে ঘুম থেকে উঠে তার হাতে কলম ধরিয়ে দেয়। বলে-

যতদিন কলম ধরা থাকবে, ততদিন তুমি হারো না।

অরুণ কাঁপা হাতে একবার লিখে ফেলেছিল

ভালোবাসা শব্দটি আমি মিনুর মুখে খুঁজি।

গেলো বছর তারা ৫০ বছর একসঙ্গে পূর্ণ করল। কোনো আড়ম্বর নেই, শুধু মিনু তার হাতে একখানা ডায়েরি তুলে দিল।

এটা তোমার। আমি ৫০ বছর ধরে প্রতি রাতে তোমার কথা লিখেছি।

অরুণ

ডায়েরিটা নিল। কিছু বলল না, শুধু দীর্ঘদিন পর চোখে জল এলো।

এখন সেই রাত। অরুণ বাঁচার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। অক্সিজেনের মুখোশ মুখে, চোখে একটাই প্রশ্ন, তুমি আছো তো?

মিনু তার হাতে হাত রাখে। বলে-

তুমি চোখ বন্ধ করো। আমি এখানেই আছি। মৃত্যুর পরেও...

অরুণ চোখ বন্ধ করে। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে গালের পাশে। সেই জলে ভিজে যায় মিনুর হাত।

সকাল। জানালার বাইরে সূর্য উঠেছে। পাখিরা ডেকে উঠছে। মিনু বিছানায় বসে আছেন একা।

অরুণ আর নেই।

তবু তার হাতের ডায়েরিটা খোলা

শেষ পাতায় লেখা

ভালোবাসা অন্তহীন, যতদিন তুমি পাশে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়